পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৬২ রবীন্দ্র-রচনাবলী পদার্থের রহস্যময় সত্তা অনুভব করিল। মানবসমাজকে কেবল আমার পক্ষ এবং অন্ত পক্ষ এই দুই সাদা কালে ভাগে অত্যন্ত বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখিবার যে ভেদবৃষ্টি তাহাই সেদিন সে ভুলিয়াছিল এবং ভিন্ন মতের মানুষকে মুখ্যভাবে মানুষ বলিয়া এমন করিয়া দেখিতে পাইয়াছিল ষে, ভিন্ন মতটা তাহার কাছে গৌণ হইয়া গিয়াছিল । সেদিন স্বচরিতা অনুভব করিয়াছিল যে, তাহার সঙ্গে আলাপ করিতে গোরা একটা আনন্দ বোধ করিতেছে । সে কি কেবলমাত্র নিজের মত প্রকাশ করিবারই আনন্দ ? সেই আনন্দদানে স্বচরিতারও কি কোনো হাত ছিল না ? হয়তো ছিল না। হয়তো গোরার কাছে কোনো মানুষের কোনো মূল্য নাই, সে নিজের মত এবং উদ্দেশু লইয়াই একেবারে সকলের নিকট হইতে মৃদুর হইয়া আছে– মানুষরা তাহার কাছে মত প্রয়োগ করিবার উপলক্ষমাত্র । স্বচরিতা এ কয়দিন বিশেষ করিয়া উপাসনায় মন দিয়াছিল । সে যেন পূর্বের চেয়েও পরেশবাবুকে বেশি করিয়া আশ্রয় করিবার চেষ্টা করিতেছিল । এক দিন পরেশবাবু তাহার ঘরে একল বসিয়া পড়িতেছিলেন, এমন সময় স্বচরিতা তাহার কাছে চুপ করিয়া আসিয়া বসিল । পরেশবাবু বই টেবিলের উপর রাখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী রাধে ?” স্বচরিতা কহিল, "কিছু না ।” বলিয়া তাহার টেবিলের উপরে যদিচ বই-কাগজ প্রভৃতি গোছানোই ছিল তনু সেগুলিকে নাড়িয়া-চাড়িয়া অন্তরকম করিয়া গুছাইতে লাগিল । একটু পরে বলিয়া উঠিল, “বাবা, আগে তুমি আমাকে যেরকম পড়াতে এখন সেইরকম করে পড়াও না কেন ?” পরেশবাবু সস্নেহে একটুখানি হাসিয়া কহিলেন, “আমার ছাত্রী যে আমার ইস্কুল থেকে পাশ করে বেরিয়ে গেছে। এখন তো তুমি নিজে পড়েই বুঝতে পার।" স্বচরিত কহিল, "না, আমি কিছু বুঝতে পারি নে, আমি আগের মতো তোমার কাছে পড়ব ।” পরেশবাবু কহিলেন, “আচ্ছা বেশ, কাল থেকে পড়াব ।” সুচরিতা আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয় হঠাৎ বলিয়া উঠিল, “বাবা, সেদিন বিনয়বাবু জাতিভেদের কথা অনেক বললেন, তুমি আমাকে সে সম্বন্ধে কিছু বুঝিয়ে বল না কেন ?” পরেশবাবু কছিলেন, “ম, তুমি তো জানই, তোমরা আপনি ভেবে বুঝতে চেষ্টা করবে, আমার বা আর-কারও মত কেবল অভ্যস্ত কথার মতো ব্যবহার করবে না,