পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ૨૭૭ বলে না, সকল কাজে উৎসাহের সঙ্গে যোগ দেয় । আগামী অভিনয়ের সাজসজ্জা ইত্যাদি সকল বিষয়ে তাহার মনে প্রত্যহ নানাপ্রকার নূতন নূতন কল্পনার উদয় হইতে লাগিল, তাছাই লইয়া সে সকলকে অস্থির করিয়া তুলিল। এ সম্বন্ধে বরদাসুন্দরীর উৎসাহ যতই বেশি হউক তিনি খরচের কথাটাও ভাবেন— সেইজন্ত, ললিতা যখন অভিনয়ব্যাপারে বিমুখ ছিল তখনও যেমন র্তাহার উৎকণ্ঠার কারণ ঘটিয়াছিল এখন তাহার উৎসাহিত অবস্থাতেও তেমনি তাহার সংকট উপস্থিত হইল। কিন্তু ললিতার উত্তেজিত কল্পনাবৃত্তিকে আঘাত করিতেও সাহস হয় না, যে কাজে সে উৎসাহ বোধ করে সে কাজের কোথাও লেশ মাত্র অসম্পূর্ণতা ঘটিলে সে একেবারে দমিয়া যায়, তাহাতে যোগ দেওয়াই তাহার পক্ষে অসম্ভব হইয় উঠে । ললিতা তাহার মনের এই উচ্ছসিত অবস্থায় মুচরিতার কাছে অনেকবার ব্যগ্র হইয়া গিয়াছে । স্বচরিত হাসিয়াছে, কথা কহিয়াছে বটে, কিন্তু ললিতা তাহার মধ্যে বারম্বার এমন একটা বাধা অনুভব করিয়াছে যে, সে মনে মনে রাগ করিয়া ফিরিয়া আসিয়াছে । একদিন সে পরেশবাবুর কাছে গিয়া কছিল, “বাবা, সুচিদিদি যে কোণে বলে বলে বই পড়বে, আর আমরা অভিনয় করতে যাব, সে হবে না । ওকে ও আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে হবে ।” পরেশবাবুও কয়দিন ভাবিতেছিলেন, স্বচরিতা তাহার সঙ্গিনীদের নিকট হইতে কেমন যেন দূরবর্তিনী হইয়া পড়িতেছে। এরূপ অবস্থা তাহার চরিত্রের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নছে বলিয়া তিনি আশঙ্কা করিতেছিলেন । ললিতার কথা শুনিয়া আজ তাহার মনে হইল, আমোদপ্রমোদে সকলের সঙ্গে যোগ দিতে না পারিলে স্বচরিতার এইরূপ পার্থক্যের ভাব প্রশ্ৰয় পাইয়া উঠিৰে । পরেশবাবু ললিতাকে কছিলেন, “তোমার মাকে বলে গে " ললিত কছিল, "মাকে আমি বলব, কিন্তু স্বচিদিদিকে রাজি করাবার ভার তোমাকে নিতে হবে ।" পরেশবাৰু যখন বলিলেন তখন স্বচরিতা আর আপত্তি করিতে পারিল না— সে আপন কর্তব্য পালন করিতে অগ্রসর হইল । স্বচরিভা কোণ হইতে বাছির হইয়া আলিতেই বিনয় তাহার সহিত পূর্বের স্থায় আলাপ জমাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু এই কয় দিনে কী-একটা হইয়াছে, ভালো করিয়া স্বচরিতার যেন নাগাল পাইল না। তাংরি মুখভ্রতে, তাহার দৃষ্টিপাতে, এমন একটা স্বদুরত্ব প্রকাশ পাইতেছে যে, তাহার কাছে অগ্রসর হইতে সংকোচ উপস্থিত হয় ।