পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ❖ ግ› অত্যন্ত বিরক্ত হইলেন, ললিতাও সন্তুষ্ট হইল না। হারানবাবু নিজে ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে দেখা করিয়া এই প্রস্তাব পূর্বেই পাকা করিয়া আসিয়াছিলেন। ললিতা যখন বলিল ব্যাপারটাকে এত স্বদীর্ঘ করিয়া তুলিলে ম্যাজিস্ট্রেট হয়তে আপত্তি করিবেন তখন হারানবাবু পকেট হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপক পত্র বাহির করিয়া ললিতার হাতে দিয়া তাকে নিরুত্তর করিয়া দিলেন । গোরা বিন! কাজে ভ্রমণে বাহির হইয়াছে, কবে ফিরিবে তাহ কেহ জানিত না । যদিও স্বচরিতা এ সম্বন্ধে কোনো কথা মনে স্থান দিবে না ভাবিয়ছিল তবু প্রতিদিনই তাহার মনের ভিতরে আশা জন্মিত যে আজ হয়তো গোরা আলিবে । এ আশা কিছুতেই সে মন হইতে দমন করিতে পারিত না । গোরার ঔদাসীন্ত এবং নিজের মনের এই অবাধ্যতায় যখন সে নিরতিশয় পীড়া বোধ করিতেছিল, যখন কোনোমতে এই জাল ছিন্ন করিয়া পলায়ন করিবার জন্ত তাহার চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিল, এমন সময় হারানবাবু এক দিন বিশেষভাবে ঈশ্বরের নাম করিয়া স্বচরিতার সহিত তাহার সম্বন্ধ পাকা করিবার জন্য পরেশবাবুকে পুনর্বার অনুরোধ করিলেন। পরেশবাবু কহিলেন, “এখন তো বিবাহের বিলম্ব আছে, এত শীঘ্র আবদ্ধ হওয়া কি ভালো ?” হারানবাবু কহিলেন, “বিবাহের পূর্বে কিছুকাল এই আবদ্ধ অবস্থায় যাপন করা উভয়ের মনের পরিণতির পক্ষে বিশেষ আবশ্যক বলে মনে করি। প্রথম পরিচয় এবং বিবাহের মাঝখানে এইরকম একটা আধ্যাত্মিক সম্বন্ধ, যাতে সাংসারিক দায়িত্ব নেই অথচ বন্ধন আছে— এটা বিশেষ উপকারী ।” পরেশবাবু কহিলেন, “আচ্ছা, স্বচরিতাকে জিজ্ঞাসা করে দেখি ” হারানবাবু কহিলেন, “তিনি তো পূর্বেই মত দিয়েছেন।” হারানবাবুর প্রতি স্বচরিতার মনের ভাব সম্বন্ধে পরেশবাবুর এখনো সন্দেহ ছিল, তাই তিনি নিজে স্বচরিতাকে ডাকিয়া তাহার নিকট হারানবাবুর প্রস্তাব উপস্থিত করিলেন। স্বচরিতা নিজের দ্বিধাগ্রস্ত জীবনকে একটা কোথাও চূড়ান্তভাবে সমর্পণ করিতে পারিলে বাচে– তাই সে এমন অবিলম্বে এবং নিশ্চিতভাবে সম্মতি দিল ষে পরেশবাবুর সমস্ত সন্দেহ দূর হইয়া গেল। বিবাহের এত পূর্বে আবদ্ধ হওয়া কর্তব্য কি না তাহা তিনি ভালোরূপ বিবেচনা করিবার জন্য স্বচরিতাকে অনুরোধ করিলেন —তৎসত্ত্বেও স্বচরিতা এ প্রস্তাবে কিছুমাত্র আপত্তি করিল না । ব্রাউনলো সাহেবের নিমন্ত্রণ সারিয়া আসিয়া একটি বিশেষ দিনে সকলকে ডাকিয়া ভাবী দম্পতির সম্বন্ধ পাকা করা হইবে এইরূপ স্থির হইল ।