পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२br० রবীন্দ্র-রচনাবলী হিন্দু নাপিত, আমার জোতজমা বিশেষ কিছু নেই বলে কুঠির লোক আমার গায়ে হাত দেয় না। আজ এ পাড়ার পুরুষ বলতে আর বড়ো কেউ নেই, আমি যদি যাই তা হলে মেয়েগুলো ভয়েই মারা যাবে ।” গোর কহিল, "আচ্ছা, খাওয়াদাওয়া করে আবার আমি আগব ।” দারুণ ক্ষুধাতৃষ্ণার সময় এই নীলকুঠির উৎপাতের মুদীর্ঘ বিবরণে রমাপতি গ্রামের লোকের উপরেই চটিয়া গেল । বেটার প্রবলের বিরুদ্ধে মাথা তুলিতে চায় ইহা গোয়ার মুসলমানের স্পর্ধা ও নিবুদ্ধিতার চরম বলিয় তাহার কাছে মনে হইল। যথোচিত শাসনের দ্বারা ইহাদের এই ঔদ্ধত্য চূর্ণ হইলেই যে ভালো হয় ইহাতে তাহার সন্দেহ ছিল না। এই প্রকারের লক্ষ্মীছাড়া বেটাদের প্রতি পুলিসের উৎপাত ঘটিয়াই থাকে এবং ঘটিতেই বাধ্য এবং ইহারাই সেজন্ত প্রধানত দায়ী এইরূপ তাহার ধারণা । মনিবের সঙ্গে মিটমাট করিয়া লইলেই তে হয়, ফেসাদ বাধাইতে যায় কেন, তেজ এখন রহিল কোথায় ? বস্তুত রমাপতির অন্তরের সহানুভূতি নীলকুঠির সাহেবের প্রতিই ছিল । মধ্যাহ্নরৌদ্রে উত্তপ্ত বালুর উপর দিয়া চলিতে চলিতে গেfরা সমস্ত পথ একটি কথাও বলিল ন} । অবশেষে গাছপালার ভিতর হইতে কাছারিবাড়ির চলি যখন কিছুদূর হইতে দেখা গেল তখন হঠাং গোরা আসিয়া কহিল, "রমাপতি তুমি খেতে যাও, আমি সেই নাপিতের বাড়ি চললুম।" রমাপতি কহিল, “সে কী কথা ! আপনি খাবেন না ? চাটুজ্জের ওখানে খাওয়দাওয়া করে তার পরে যাবেন ।” * গোরা কহিল, “আমার কর্তব্য আমি করব, এখন তুমি খাওয়াদাওয়া সেরে কলকাতায় চলে যেয়ো— ওষ্ট ঘোষপুর-চরে আমাকে বোধ হয় কিছুদিন থেকে যেতে হবে— তুমি সে পারবে না ।” রমাপতির শরীর কণ্টকিত হইয়া উঠিল । গোরার মতো ধর্মপ্রাণ হিন্দু ওই মেচ্ছের ঘরে বাস করিবার কথা কোন মূপে উচ্চারণ করিল তাই সে ভাবিয়া পাইল না । গোরা কি পানভোজন পরিত্যাগ করিয়া প্রায়োপবেশনের সংকল্প করিয়াছে তাই সে ভাবিতে লাগিল। কিন্তু তখন ভাবিবার সময় নহে, এক-এক মুহূর্ত তাহার কাছে এক-এক यूंशं বলিয়া বোধ হইতেছে ; গোরার সঙ্গ ত্যাগ করিয়া কলিকাতায় পলায়নের জন্ত তাহাকে অধিক অনুরোধ করিতে হইল না। ক্ষণকালের জন্য রমাপতি চাহিয়া দেখিল, গোরার সুদীর্ঘ দেহ একটি খর্ব ছায়া ফেলিয়; মধ্যাঙ্কের খররেীত্রে জনশূন্ত তপ্ত বালুকার মধ্য দিয়া একাকী ফিরিয়৷ চলিয়াছে।