পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

७२• রবীন্দ্র-রচনাবলী সমাজের নিয়ম আমি জানি না ; এ বাড়িতে আমার অধিকার যে কোন সীমা পর্যন্ত তাহা আমার কিছুই জানা নাই । আমি হয়তো মূঢ়ের মতো এমন জায়গায় প্রবেশ করিতেছি যেখানে আত্মীয় ছাড়া কাহারও গতিবিধি নিষেধ।’ এই কথা ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ তাহার মনে হইল, ললিত হয়তো আজ তাহার মুখের ভাবে এমন একটা-কিছু দেখিতে পাইয়াছে যাহাতে সে অপমান বোধ করিয়াছে। ললিতার প্রতি বিনয়ের মনের ভাব যে কী এতদিন তাহা বিনয়ের কাছে স্পষ্ট ছিল না। আজ আর তাহা গোপন নাই। হৃদয়ের ভিতরকার এই নুতন অভিব্যক্তি লইয়া যে কী করিতে হইবে তাহা সে কিছুই ভাবিয়া পাইল না । বাহিরের সঙ্গে ইহার যোগ কী, সংসারের সঙ্গে ইহার সম্বন্ধ কী, ইহা কি ললিতার প্রতি অসম্মান, ইহা কি পরেশবাবুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, তাহ লইয়া সে সহস্রবার করিয়া তোলাপাড়া করিতে লাগিল । ললিতার কাছে সে ধরা পড়িয়া গেছে এবং সেইজন্যই ললিতা তাহার প্রতি রাগ করিয়াছে, এই কথা কল্পনা করিয়া সে যেন মাটির সঙ্গে মিশিয়া যাইতে লাগিল । পরেশবাবুর বাড়ি যাওয়া বিনয়ের পক্ষে অসম্ভব হইল এবং নিজের বাসার শূন্ততাও যেন একটা ভারের মতো হইয় তাহাকে চাপিতে লাগিল । পরদিন ভোরের বেলাই সে আনন্দময়ীর কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল । কহিল, “মা, কিছুদিন আমি তোমার এখানে থাকব ।” আনন্দময়ীকে গোরার বিচ্ছেদশোকে সাস্তুন দিবার অভিপ্রায় ৪ বিনয়ের মনের মধ্যে ছিল । তাহা বুঝিতে পারিয়া আনন্দময়ীর হৃদয় বিগলিত হইল । কোনো কথা না বলিয়া তিনি সস্নেহে একবার বিনয়ের গায়ে হাত বুলাইয়া দিলেন। বিনয় তাহার খাওয়াদাওয়া সেবাশুশ্ৰুষা লইয়। বহুবিধ আবদার জুড়িয়া দিল । এখানে তাহার যথোচিত যত্ব হইতেছে না বলিয়া সে মাঝে মাঝে আনন্দময়ীর সঙ্গে মিথ্যা কলহ করিতে লাগিল । সর্বদাই সে গোলমাল বকবিকি করিয়া আনন্দময়ীকে ও নিজেকে ভুলাইয়া রাখিতে চেষ্টা করিল। সন্ধ্যার সময় যখন মনকে বাধিয়া রাখা দুঃসাধ্য হইত, তখন বিনয় উংপাত করিয়া আনন্দময়ীকে তাহার সকল গৃহকর্ম হইতে ছিনাইয়া লইয়া ঘরের সম্মুখের বারান্দায় মাদুর পতিয়া বলিত ; আনন্দময়ীকে তাহার ছেলেবেলার কথা, তাহার বাপের বাড়ির গল্প বলাইত ; যখন তাহার বিবাহ হয় নাই, যখন তিনি তাহার অধ্যাপক পিতামহের টেলের ছাত্রদের অত্যন্ত আদরের শিশু ছিলেন, এবং পিতৃহীনা বালিকাকে সকলে মিলিয়া সকল বিষয়েই প্রশ্রয় দিত বলিয়া তাহার বিধবা মাতার বিশেষ উদবেগের কারণ ছিলেন, সেই সকল দিনের