পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩২৬ রবীন্দ্র-রচনাবলী বিনয় ললিতার দিকে একবার দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া লইয়া কহিল, “ঘন ঘন বিরক্ত করলে পাছে আপনাদের স্নেহ হারাই, মনে এই ভয় হয়।” স্বচরিতা একটু হাসিয়া কহিল, “স্নেহও যে ঘন ঘন বিরক্তির অপেক্ষ রাখে, সে আপনি জানেন না বুঝি ?” আনন্দময়ী কহিলেন, “তা ও খুব জানে মা ! কী বলব তোমাদের– সমস্ত দিন ওর ফরমাশে আর আবদারে আমার যদি একটু অবসর থাকে।” এই বলিয়া স্নিগ্ধদৃষ্টি-দ্বারা বিনয়কে নিরীক্ষণ করিলেন। বিনয় কহিল, “ঈশ্বর তোমাকে ধৈর্য দিয়েছেন, আমাকে দিয়ে তারই পরীক্ষা করিয়ে নিচ্ছেন।” স্বচরিতা ললিতাকে একটু ঠেলা দিয়া কহিল, “শুনছিল ভাই ললিতা, আমাদের পরীক্ষাটা বুঝি শেষ হয়ে গেল ! পাস করতে পারি নি বুঝি ?” ললিতা এ কথায় কিছুমাত্র যোগ দিল না দেখিয়া আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “এবার আমাদের বিমু নিজের ধৈর্যের পরীক্ষা করছেন । তোমাদের ও যে কী চক্ষে দেখেছে সে তো তোমরা জান না । সন্ধেবেলায় তোমাদের কথা ছাড়া কথা নেই। আর পরেশবাবুর কথা উঠলে ও তো একেবারে গলে যায়।” আনন্দময়ী ললিতার মুখের দিকে চাহিলেন ; সে খুব জোর করিয়া চোখ তুলিয়া রাখিল বটে, কিন্তু বৃথা লাল হইয়া উঠিল । আনন্দময়ী কহিলেন, “তোমার বাবার জন্যে ও কত লোকের সঙ্গে ঝগড়া করেছে ! ওর দলের লোকেরা তো ওকে ব্রাহ্ম বলে জাতে ঠেলবার জো করেছে । বিষ্ণু, অমন অস্থির হয়ে উঠলে চলবে না বাছা— সত্যি কথাই বলছি । এতে লজ্জা করবারও তো কোনো কারণ দেখি নে। কী বল মা ?” এবার ললিতার মুখের দিকে চাহিতেই তাহার চোখ নামিয়া পড়িল । স্বচরিতা কহিল, “বিনয়বাবু যে আমাদের আপনার লোক বলে জানেন সে আমরা খুব জানি— কিন্তু সে যে কেবল আমাদেরই গুণে তা নয়, সে ওঁর নিজের ক্ষমতা ।” আনন্দময়ী কহিলেন, “তা ঠিক বলতে পারি নে মা ! ওকে তো এতটুকুবেল থেকে দেখছি, এতদিন ওর বন্ধুর মধ্যে এক আমার গোরাই ছিল ; এমনকি, আমি দেখেছি ওদের নিজের দলের লোকের সঙ্গেও বিনয় মিলতে পারে না । কিন্তু তোমাদের সঙ্গে ওর দু দিনের আলাপে এমন হয়েছে যে আমরাও ওর আর নাগাল পাই নে। ভেবেছিলুম এই নিয়ে তোমাদের সঙ্গে ঝগড়া করব, কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি আমাকেও ওরই দলে ভিড়তে হবে । তোমরা সক্কলকেই হার মানাবে।”