পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ও ঘরে ঘুরিয়াছে তাহার ঠিক নাই। অবশেষে দিন যখন অবসান হয়, রাত্রে যখন লে বিছানায় শুইতে যায়, তখন সে নিজের মনখানা লইয়া কী যে করিবে ভাবিয়া পায় না । বুক ফাটিয়া কান্না আসে— সঙ্গে সঙ্গে রাগ হইতে থাকে, কাছার উপরে রাগ বুঝিরা উঠাই শক্ত। রাগ বুঝি নিজের উপরেই। কেবলই মনে হয়, “এ কী হইল ! আমি বঁচিব কী করিয়া ! কোনো দিকে তাকাইয়া যে কোনো রাস্তা দেখিতে পাই না । এমন করিয়া কতদিন চলিবে ? ললিতা জানে, বিনয় হিন্দু, কোনোমতেই বিনয়ের সঙ্গে তাহার বিবাহ হইতে পারে না। অথচ নিজের হৃদয়কে কোনোমতেই ৰশ, মানাইতে না পারিয়া লজ্জার ভয়ে তাহার প্রাণ শুকাইয়া গেছে। বিনয়ের হৃদয় যে তাহার প্রতি বিমুখ নহে এ কথা সে বুকিয়াছে ; ৰুকিয়াছে বলিয়াই নিজেকে সম্বরণ করা তাহার পক্ষে আজ এত কঠিন হইয়াছে । সেই জন্তই সে যখন উতলা হইয়া বিনয়ের আশাপথ চাহিয়া থাকে সেই সঙ্গেই তাহার মনের ভিতরে একটা ভয় হইতে থাকে, পাছে বিনয় আসিয়া পড়ে । এমনি করিয়া নিজের সঙ্গে টানাটানি করিতে করিতে আজ সকালে তাহার ধৈর্ষ আর বাধ মানিল না। তাছার মনে হইল, বিনয় না আসাতেই তাহার প্রাণের ভিতরটা কেবলই অশাস্ত হইয়া উঠিতেছে, এক বার দেখা হইলেই এই অস্থিরতা দূর হইয়া যাইবে । সকালবেলা সে সতীশকে নিজের ঘরের মধ্যে টানিয়া আনিল । সতীশ আজকাল মাসীকে পাইয়া বিনয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বচর্চার কথা এক রকম ভুলিয়াই ছিল । ললিতা তাহাকে কহিল, “বিনয়বাবুর সঙ্গে ভোর বুঝি ঝগড়া হয়ে গেছে ?” সে এই অপবাদ সতেজে অস্বীকার করিল । ললিতা কছিল, “ভারি তো তোর বন্ধু ! তুইই কেবল বিনয়বাবু বিনয়বাবু করিল, তিনি তো ফিরেও তাকান না।” সতীশ কছিল, “ইস ! তাই তো ! ককখনো না!” পরিবারের মধ্যে ক্ষুদ্রতম সতীশকে নিজের গৌরব সপ্রমাণ করিবার জন্য এমনি করিয়া বারম্বার গলার জোর প্রয়োগ করিতে হয় । আজ প্রমাণকে তাহার চেয়েও দৃঢ়তর করিবার জন্য সে তখনই বিনয়ের বাসায় চুটিয়া গেল। ফিরিয়া আসিয়া কহিল, "তিনি যে বাড়িতে নেই, তাই জন্তে আসতে পারেন নি ।” ললিতা জিজ্ঞাসা করিল, “এ ক'দিন আসেন নি কেন ?” সতীশ কছিল, “ক’দিনই যে ছিলেন না।” তখন ললিতা স্বচরিতার কাছে গিয়া কছিল, "দিভিাই, গৌরবাবুর মায়ের কাছে আমাদের কিন্তু এক ৰায় ৰাওয়া উচিত।” স্বচরিতা কছিল, "তাদের সঙ্গে যে পরিচয় নেই।”