পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\99o রবীন্দ্র-রচনাবলী ললিত কহিল, "বাঃ, গৌরবাবুর বাপ যে বাবার ছেলেবেলাকার বন্ধু ছিলেন ।” স্বচরিতার মনে পড়িয়া গেল, কহিল, “হা, তা বটে ।” স্বচরিতাও অত্যন্ত উৎসাহিত হইয়া উঠিল । কহিল, "ললিতা ভাই, তুমি যাও, বাবার কাছে বলে গে ।” ললিত কহিল, "না, আমি বলতে পারব না, তুমি বলে গে।” শেষকালে মুচরিতাই পরেশবাবুর কাছে গিয়া কথাটা পাড়িতেই তিনি বলিলেন, "ঠিক বটে, এতদিন আমাদের যাওয়া উচিত ছিল ।” আহারের পর যাওয়ার কথাটা যখনি স্থির হইয়া গেল তখনি ললিতার মন বকিয়া উঠিল। তখন আবার কোথা হইতে অভিমান এবং সংশয় আসিয়া তাহাকে উলট দিকে টানিতে লাগিল। স্বচরিতাকে গিয়া সে কহিল, "দিদি, তুমি বাবার সঙ্গে যাও। আমি যাব না ।” মুচরিত কহিল, “সে কি হয়! তুই না গেলে আমি একলা যেতে পারব না । লক্ষ্মী আমার, ভাই আমার— চল ভাই, গোল করিস নে ৷” অনেক অনুনয়ে ললিতা গেল । কিন্তু বিনয়ের কাছে সে যে পরাস্ত হইয়াছে— বিনয় অনায়াসেই তfহাদের বাড়ি না আসিয়া পারিল, আর সে আজ বিনয়কে দেখিতে ছুটিয়াছে— এই পরাভবের অপমানে তাহার বিষম একটা রাগ হইতে লাগিল। বিনয়কে এখানে দেখিতে পাইবার আশাতেই আনন্দময়ীর বাড়ি আসিবার জন্য যে তাহার এতটা আগ্রহ জন্মিয়াছিল, এই কথাটা সে মনে মনে একেবারে অস্বীকার করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল এবং নিজের সেই জিদ বজায় রাখিবার জন্য, না বিনয়ের দিকে তাকাইল, না তাহার নমস্কার ফিরাইয়া দিল, না তাহার সঙ্গে একটা কথা কহিল । বিনয় মনে করিল, ললিতার কাছে তাহার মনের গোপন কথাটা ধরা পড়িয়াছে বলিয়াই সে অবজ্ঞার দ্বারা তাহাকে এমন করিয়া প্রত্যাখ্যান করিতেছে । ললিতা যে তাহাকে ভালোবাসিতেও পারে, এ কথা অনুমান করিবার উপযুক্ত আত্মাভিমান বিনয়ের ছিল না । বিনয় আসিয়া সংকোচে দরজার কাছে দাড়াইয়া কহিল, “পরেশবাবু এখন বাড়ি যেতে চাচ্ছেন, এঁদের সকলকে খবর দিতে বললেন ।” ললিত যাহাতে তাহাকে না দেখিতে পায় এমন করিয়াই বিনয় দাড়াইয়াছিল । আনন্দময়ী কছিলেন, “সে কি হয়! কিছু মিষ্টমুখ না করে বুঝি যেতে পারেন! আর বেশি দেরি হবে না। তুমি এখানে একটু বোলো বিনয়, আমি এক বার দেখে আসি । বাইরে দাড়িয়ে রইলে কেন, ঘরের মধ্যে এসে বোলো ।”