পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ՏNՑԵր রবীন্দ্র-রচনাবলী সে যে সত্যই চলিল সে কি আমি জানিতাম ! সে যাইতে চাহে নাই, আমি জোর করিয়া তাহাকে বিদায় করিয়াছি— এই দুঃখে বুক আজ পর্যন্ত পুড়িতেছে, সে আর কিছুতেই শীতল হইল না। সেই রাত্রেই গর্ভপাত হইয়া মনোরমার মৃত্যু হইল। এই খবর যখন পাইলাম তাহার পূর্বেই গোপনে তাড়াতাড়ি তাহার সংকার শেষ হইয়া গেছে। যাহার কিছু বলিবার নাই, করিবার নাই, ভাবিয়া যাহার কিনারা পাওয়া যায় না, কাদিয়া যাহার অস্ত হয় না, সেই দুঃখ যে কী দুঃখ, তাহা তোমরা বুঝিবে না— সে বুঝিয়া কাজ নাই । আমার তো সবই গেল কিন্তু তবু আপদ চুকিল না। আমার স্বামীপুত্রের মৃত্যুর পর হইতেই দেবররা আমার বিষয়ের প্রতি লোভ দিতেছিল। তাহারা জানিত আমার মৃত্যুর পরে বিষয়সম্পত্তি সমুদয় তাহদেরই হইবে, কিন্তু ততদিন পর্যন্ত তাহদের সবুর সহিতেছিল না । ইহাতে কাহারও দোষ দেওয়া চলে না ; সত্যই আমার মতো অভাগিনীর বাচিয়া থাকাই যে অপরাধ ! সংসারে যাহাদের নানা প্রয়োজন আছে, আমার মতো প্রয়োজনহীন লোক বিনা হেতুতে তাহাদের জায়গা জুড়িয়া বাচিয়া থাকিলে লোকে সহ করে কেমন করিয়া ! মনোরমা যতদিন বাচিয়া ছিল ততদিন আমি দেবরদের কোনো কথায় ভূলি নাই। আমার বিষয়ের অধিকার লইয়া যতদূর সাধ্য তাহদের সঙ্গে লড়িয়াছি । আমি যতদিন বাচি মনোরমার জন্ত টাকা সঞ্চয় করিয়া তাহাকে দিয়া যাইব, এই আমার পণ ছিল । আমি আমার কন্যার জন্য টাকা জমাইবার চেষ্টা করিতেছি ইহাই আমার দেবরদের পক্ষে অসহ হইয়া উঠিয়াছিল— তাহাদের মনে হইত আমি তাহাদেরই ধন চুরি করিতেছি । নীলকান্ত বলিয়া কর্তার এক জন পুরাতন বিশ্বাসী কর্মচারী ছিল, সেই আমার সহায় ছিল । আমি যদি বা আমার প্রাপ্য কিছু ছাড়িয়া দিয়া আপোষে নিম্পত্তির চেষ্টা করিতাম সে কোনোমতেই রাজি হইত না ; সে বলিত— আমাদের হকের এক পয়সা কে লয় দেখিব । এই হকের লড়াইয়ের মাঝখানেই আমার কন্যার মৃত্যু হইল । তাহার পরদিনেই আমার মেজ দেবর আসিয়া আমাকে বৈরাগ্যের উপদেশ দিলেন । বলিলেন— বৌদিদি, ঈশ্বর তোমার যা অবস্থা করিলেন তাহাতে তোমার আর সংসারে থাকা উচিত হয় না । যে কয়দিন বাচিয়া থাক তীর্থে গিয়া ধর্মকর্মে মন দাও, আমরা তোমার খাওয়াপরার বন্দোবন্ত করিয়া দিব |