পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 98ዓ প্রবেশ করিতে প্রবৃত্ত হইলে স্বচরিতা পথরোধ করিয়া দাড়াইয়া বলিল, “ও ঘরে যেয়ে না ।” “কেন ?” “ও ঘরে ওঁর ঠাকুর আছে।” “ঠাকুর আছে! তুমি বুঝি রোজ ঠাকুর পুজো কর।” হরিমোহিনী বলিলেন, “ই মা, পুজো করি বইকি ৷” “ঠাকুরকে তোমার ভক্তি হয় ?” “পোড়া কপাল আমার! ভক্তি আর কই হল! ভক্তি হলে তো বেঁচেই যেতুম !” সেদিন ললিতা উপস্থিত ছিল। সে মুখ লাল করিয়া প্রশ্নকারিণীকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি যার উপাসনা কর তাকে ভক্তি কর ?” ‘‘বf:, ভক্তি করি নে তো কী !” ললিতা সবেগে মাথা নাড়িয়া কহিল, ‘ভক্তি তো করই না, আর, ভক্তি ষে কর না সেটা তোমার জানাও নেই ।” স্বচরিতা যাহাতে আচারব্যবহারে তাহার দল হইতে পৃথক না হয় সেজন্য হরিমোহিনী অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য হইতে পারিলেন না । ইতিপূর্বে হারানবাবুতে বরদাসুন্দরীতে ভিতরে ভিতরে একটা বিরোধের ভাবই ছিল । বর্তমান ব্যাপারে উভয়ের মধ্যে খুব মিল হইল । বরদাসুন্দরী কহিলেন— যিনি যাই বলুন-না কেন, ব্রাহ্মসমাজের আদর্শকে বিশুদ্ধ রাখিবার জন্য যদি কাহারও দৃষ্ট থাকে তো সে পাস্তুবাবুর। হারানবাবুও– ব্রাহ্মপরিবারকে সর্বপ্রকারে নিষ্কলঙ্ক রাখিবার প্রতি বরদাসুন্দরীর একান্ত বেদনাপূর্ণ সচেতনতাকে ব্রাহ্মগৃহিণীমাত্রেরই পক্ষে একটি স্বৰ্দষ্টান্ত বলিয়া সকলের কাছে প্রকাশ করিলেন । তাহার এই প্রশংসার মধ্যে পরেশবাবুর প্রতি বিশেষ একটু খোচা ছিল। হারানবাবু এক দিন পরেশবাবুর সম্মুখেই স্বচরিতাকে কহিলেন, “শুনলুম না কি আজকাল তুমি ঠাকুরের প্রসাদ খেতে আরম্ভ করেছ।” স্বচরিতার মুখ লাল হইয়া উঠিল, কিন্তু যেন সে কথাটা শুনিতেই পাইল না এমনিভাবে টেবিলের উপরকার দোয়াতদানিতে কলমণ্ডলা গুছাইয়া রাথিতে লাগিল। পরেশবাবু এক বার করুণনেত্রে স্বচরিতার মুখের দিকে চাহিয়া হাবানবাবুকে কহিলেন, “পাল্লুবাবু, আমরা যা-কিছু খাই সবই তো ঠাকুরের প্রসাদ ।” হারানবাবু কছিলেন, “কিন্তু স্বচরিতা যে আমাদের ঠাকুরকে পরিত্যাগ করবার উদ্যোগ করছেন।”