পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ꮼ©Ꮼ রবীন্দ্র-রচনাবলী কিন্তু আমি ঠকিলাম”— এই বলিয়া খুব আড়ম্বর করিয়া বিনয় আহারে বসিয়াছে এমন সময় বরদাস্থন্দরী আসিয়া উপস্থিত হইলেন । বিনয় তাহার থালার উপরে যথাসম্ভব নত হইয়া নমস্কারের চেষ্টা করিয়া কহিল, "অনেকক্ষণ নীচে ছিলুম ; আপনার সঙ্গে দেখা হল ন৷ ” বরদাসুন্দরী তাহার কোনো উত্তর না করিয়া স্বচরিতার প্রতি লক্ষ করিয়া কহিলেন, “এই-ষে ইনি এখানে ! আমি যা ঠাউরেছিলুম তাই। সভা বলেছে। আমোদ করছেন। এ দিকে বেচার হারানবাবু সকাল থেকে ওঁর জন্তে অপেক্ষা করে বসে রয়েছেন, যেন তিনি ওঁর বাগানের মালী । ছেলেবেলা থেকে ওদের মানুষ করলুম— কই বাপু, এত দিন তো ওদের এ-রকম ব্যবহার কখনো দেখি নি। কে জানে আজকাল এ-সব শিক্ষা কোথা থেকে পাচ্ছে । আমাদের পরিবারে যা কখনো ঘটতে পারত না আজকাল তাই আরম্ভ হয়েছে— সমাজের লোকের কাছে যে আমাদের মুখ দেখাবার জো রইল না। এত দিন ধরে এত করে ষা শেখানো গেল সে সমস্তই দু দিনে বিসর্জন দিলে। এ কী সব কাণ্ড!” হরিমোহিনী শশব্যস্ত হইয়া উঠিয়া স্নচরিতাকে কহিলেন, “নীচে কেউ বসে আছেন আমি তো জানতেম না । বড়ো অন্যায় হয়ে গেছে তো । মা, যাও তুমি শীঘ্ৰ যাও । আমি অপরাধ করে ফেলেছি।” অপরাধ যে হরিমোহিনীর লেশমাত্র নহে ইহাই বলিবার জন্য ললিতা মুহুর্তের মধ্যে উদ্যত হইয়া উঠিয়াছিল । স্বচরিত। গোপনে সবলে তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া তাহাকে নিরস্ত করিল এবং কোনো প্রতিবাদমাত্র না করিয়৷ নীচে চলিয়া গেল । পূর্বেই বলিয়াছি বিনয় বরদাসুন্দরীর স্নেহ আকর্ষণ করিয়াছিল । বিনয় যে তাহাদের পরিবারের প্রভাবে পড়িয়া ক্রমে ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করিবে এ সম্বন্ধে তাহার সন্দেহ ছিল না । বিনয়কে তিনি যেন নিজের হাতে গড়িয়া তুলিতেছেন বলিয়া একটা বিশেষ গর্ব অনুভব করিতেছিলেন ; সে গর্ব তিনি তাহার বন্ধুদের মধ্যে কারও কারও কাছে প্রকাশও করিয়াছিলেন । সেই বিনয়কে আজ শক্রপক্ষের শিবিরের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত দেখিয়া তাহার মনের মধ্যে যেন একটা দাহ উপস্থিত হইল এবং নিজের কন্যা ললিতাকে বিনয়ের পুনঃপতনের সহায়কারী দেখিয়া তাহার চিত্তজালা যে আরও দ্বিগুণ বাড়িয়া উঠিল সে কথা বলা বাহুল্য । তিনি রুক্ষস্বরে কছিলেন, “ললিতা, এখানে কি তোমার কোনো কাজ আছে ?” ললিত কহিল, “হা, বিনয়বাবু এসেছেন তাই—“ বরদাসুন্দরী কছিলেন, “বিনয়বাবু যার কাছে এসেছেন তিনি ওঁর আতিথ্য করবেন, তুমি এখন নীচে এল, কাজ আছে।”