পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ©¢ፃ ললিতা স্থির করিল, হারানবাৰু নিশ্চয়ই বিনয় ও তাহার দুই জনের নাম লইয়া মাকে এমন কিছু বলিয়াছেন যাহা বলিবার অধিকার তাহার নাই। এই অনুমান করিয়া তাহার মন অত্যন্ত শক্ত হইয়া উঠিল । সে অনাবগুক প্ৰগলভতার সহিত কহিল, “বিনয়বাৰু অনেক দিন পরে এসেছেন, ওঁর সঙ্গে একটু গল্প করে নিয়ে তার পরে আমি যাচ্ছি । বরদাসুন্দরী ললিতার কথার স্বরে বুঝিলেন, জোর খাটিবে না । হরিমোহিনীর সম্মুখেই পাছে র্তাহার পরাভব প্রকাশ হইয়া পড়ে এই ভয়ে তিনি আর-কিছু না বলিয়া এবং বিনয়কে কোনোপ্রকার সম্ভাষণ না করিয়া চলিয়া গেলেন । ললিতা বিনয়ের সঙ্গে গল্প করিবার উৎসাহ তাহার মার কাছে প্রকাশ করিল বটে, কিন্তু বরদাসুন্দরী চলিয়া গেলে লে উৎসাহের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না । তিন জনেই কেমন একপ্রকার কুষ্ঠিত হইয়া রহিল এবং অল্পক্ষণ পরেই ললিত উঠিয়া গিয়া নিজের ঘরে প্রবেশ করিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিল । এ বাড়িতে হরিমোহিনীর যে কিরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে তাহা বিনয় স্পষ্টই বুঝিতে পারিল । কথা পাড়িয়া ক্রমশ হরিমোহিনীর পূর্ব-ইতিহাস সমস্তই সে শুনিয়া লইল । সকল কথার শেষে হরিমোহিনী কহিলেন, “বাবা, আমার মতো অনাথার পক্ষে সংসার ঠিক স্থান নয় । কোনো তীর্থে গিয়ে দেবসেবায় মন দিতে পারলেই আমার পক্ষে ভালে হত। আমার অল্প যে ক'টি টাকা বাকি রয়েছে তাতে আমার কিছুদিন চলে যেত, তার পরেও যদি বেঁচে থাকতুম তো পরের বাড়িতে রেধে খেয়েও আমার কোনোমতে দিন কেটে যেত । কাশীতে দেখে এলুম, এমন তো কত লোকের বেশ চলে যাচ্ছে । কিন্তু আমি পাপিষ্ঠ বলে সে কোনোমতেই পেরে উঠলুম না। একলা থাকলেই আমার সমস্ত দুঃখের কথা আমাকে যেন ঘিরে বলে, ঠাকুর-দেবতা কাউকে আমার কাছে আসতে দেয় না । ভয় হয় পাছে পাগল হয়ে যাই । যে মানুষ ডুবে মরছে তার পক্ষে ভেল| যেমন, রাধারানী আর সতীশ আমার পক্ষে তেমনি হয়ে উঠেছে— ওদের ছাড়বার কথা মনে করতে গেলেই দেখি আমার প্রাণ হাপিয়ে ওঠে । তাই আমার দিনরাত্রি ভয় হয় ওদের ছাড়তেই হবে— নইলে সব খুইয়ে আবার এই ক’দিনের মধ্যেই ওদের এত ভালোবাসতে গেলুম কী জন্তে ? বাবা, তোমার কাছে বলতে আমার লজ্জা নেই, এদের দুটিকে পাওয়ার পর থেকে ঠাকুরের পুজো আমি মনের সঙ্গে করতে পেরেছি— এরা যদি যায় তবে আমার ঠাকুর তখনই কঠিন পাথর হয়ে বাবে ।” এই বলিয়া বস্বাঞ্চলে হরিমোহিনী দুই চক্ষু মুছিলেন।