পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা లe) উপাসনায় ৰসিতেন, তাহার শুরুকেশমণ্ডিত শাস্তমুখের উপর স্বর্যান্তের আভা আসিয়া পড়িত। সেই সময়ে স্বচরিতা নিঃশব্দপদে চুপ করিয়া তাহার কাছে আসিয়া বলিত । নিজের অশাস্ত ব্যথিত চিত্তটিকে সে যেন পরেশের উপাসনার গভীরতার মাঝখানে নিমজ্জিত করিয়া রাধিত । আজকাল উপাসনাস্তে প্রায়ই পরেশ দেখিতে পাইতেন তাহার এই কন্যাটি, এই ছাত্ৰীটি স্তন্ধ হইয়া তাহার কাছে বসিয়া আছে ; তখন তিনি একটি অনির্বচনীয় আধ্যাত্মিক মাধুর্যের দ্বারা এই বালিকাটিকে পরিবেষ্টিত দেখিয়া সমস্ত অন্ত:করণ দিয়া নিঃশব্দে ইহাকে আশীৰ্বাদ করিতেন । ভূমার সহিত মিলনকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য করিয়াছিলেন বলিয়া বাহা শ্ৰেয়তম এবং সত্যতম পরেশের চিত্ত সর্বদাই তাহার অভিমুখ ছিল । এইজন্ত সংসার কোনোমতেই তাহার কাছে অত্যন্ত গুরুতর হইয়া উঠিতে পারিত না । এইরূপে নিজের মধ্যে তিনি একটি স্বাধীনতা লাভ করিয়াছিলেন বলিয়াই মত বা আচরণ লইয়া তিনি অন্তের প্রতি কোনোপ্রকার জবৰ্দ্দস্তি করিতে পারিতেন না । মঙ্গলের প্রতি নির্ভর এবং সংসারের প্রতি ধৈর্য র্তাহার পক্ষে অত্যস্ত স্বাভাবিক ছিল । ইহা তাহার এত অধিক পরিমাণে ছিল যে সাম্প্রদায়িক লোকের কাছে তিনি নিন্দিত হইতেন, কিন্তু নিন্দাকে তিনি এমন করিয়া গ্রহণ করিতে পারিতেন যে হয়তো তাহা র্তাহাকে আঘাত করিত, কিন্তু তাহাকে বিদ্ধ করিয়া থাকিত না । তিনি মনের মধ্যে এই কথাটাই কেবলই থাকিয়া থাকিয়া আবৃত্তি করিতেন— ‘আমি আর-কাহারও হাত হইতে কিছুই লইব না, আমি তাহার হাত হইতেই সমস্ত লইব ।’ পরেশের জীবনের এই গভীর নিস্তব্ধ শাস্তির স্পর্শ লাভ করিবার জন্ত আজকাল স্বচরিতা নানা উপলক্ষ্যেই তাহার কাছে আসিয়া উপস্থিত হয় । এই অনভিজ্ঞ বালিকাবয়সে তাহার বিরুদ্ধ হৃদয় এবং বিরুদ্ধ সংসার যখন তাহাকে একেবারে উদভ্ৰাস্ত করিয়া তুলিয়াছে তখন সে বার বার কেবল মনে করিয়াছে, বাবার পা দুখানা মাথায় চাপিয়া ধরিয়া খানিকক্ষণের জন্ত যদি মাটিতে পড়িয়া থাকিতে পারি তবে আমার মন শাস্তিতে ভরিয়া উঠে।” এইরূপে স্বচরিতা মনে ভাবিতেছিল, সে মনের সমস্ত শক্তিকে জাগ্রত করিয়া অবিচলিত ধৈর্যের সহিত সমস্ত আঘাতকে ঠেকাইয়া রাখিবে, অবশেষে সমস্ত প্রতিকূলতা আপনি পরাস্ত হইয়া যাইবে । কিন্তু সেরূপ ঘটিল না, তাহাকে অপরিচিত পথে বাহির হইতে হইল । বরদাসুন্দরী যখন দেখিলেন রাগ করিয়া, ভৎসনা করিয়া, স্বচরিতাকে টলানো সম্ভব নহে এবং পরেশকেও সহায়রপে পাইবার কোনো আশা নাই, তখন হরিমোহিনীর