পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা : లa9 8ථ পরেশবাবুর বাসার কাছেই সর্বদা তাহার তত্ত্বাবধানে থাকিয়া বাস করিতে পাইবে এই কথা শুনিয়া স্বচরিতা অত্যস্ত আরামবোধ করিয়াছিল । কিন্তু যখন তাহার নূতন বাড়ির গৃহসজ্জা সমাপ্ত এবং সেখানে উঠিয়া যাইবার সময় নিকটবর্তী হইল তখন স্বচরিতার বুকের ভিতর যেন টানিয়া ধরিতে লাগিল। কাছে থাকা না-থাকা লইয়া কথা নয়, কিন্তু জীবনের সঙ্গে জীবনের যে সর্বাঙ্গীণ যোগ ছিল তাহাতে এত দিন পরে একটা বিচ্ছেদ ঘটবার কাল আসিয়াছে ইহা আজ স্বচরিতার কাছে যেন তাহার এক অংশের মৃত্যুর মতো বোধ হইতে লাগিল । এই পরিবারের মধ্যে স্বচরিতার যেটুকু স্থান ছিল, তাহার যে-কিছু কাজ ছিল, প্রত্যেক চাকরটির সঙ্গেও তাহার যে সম্বন্ধ ছিল, সমস্তই স্বচরিতার হৃদয়কে ব্যাকুল করিয়া তুলিতে লাগিল । স্বচরিতার যে নিজের কিছু সংগতি আছে এবং সেই সংগতির জোরে আজ সে স্বাধীন হইবার উপক্রম করিতেছে এই সংবাদে বরদাসুন্দরী বার বার করিয়া প্রকাশ করিলেন যে, ইহাতে ভালোই হইল, এতদিন এত সাবধানে যে দায়িত্বভার বহন করিয়া আসিতেছিলেন তাহা হইতে মুক্ত হইয়া তিনি নিশ্চিস্ত হইলেন । কিন্তু মনে মনে সুচরিতার প্রতি র্তাহার যেন একটা অভিমানের ভাব জন্মিল ; স্নচরিতা যে তাহদের কাছ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া আজ নিজের সম্বলের উপর নির্ভর করিয়া দাড়াইতে পারিতেছে এ যেন তাহার একটা অপরাধ । তাহারা ছাড়া স্বচরিতার অন্য কোনো গতি নাই ইহাই মনে করিরা অনেক সময় স্বচরিতাকে তিনি আপন পরিবারের একটা আপদ বলিয়া নিজের প্রতি করুণা অনুভব করিয়াছেন, কিন্তু সেই স্বচরিতার ভার যখন লাঘব হইবার সংবাদ হঠাৎ পাইলেন তখন তো মনের মধ্যে কিছুমাত্র প্রসন্নতা অনুভব করিলেন না । তাহদের আশ্রয় স্বচরিতার পক্ষে অত্যাবশুক নহে ইহাই জানিয়া সে ষে গর্ব অনুভব করিতে পারে, তাহাদের আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য না হইতে পারে, এই কথা মনে করিয়া তিনি আগে হইতেই তাহাকে অপরাধী করিতে লাগিলেন । এ কয়দিন বিশেষভাবে তাহার প্রতি দূরত্ব রক্ষা করিয়া চলিলেন। পূর্বে তাহাকে ঘরের কাজ-কর্মে যেমন করিয়া ডাকিতেন এখন তাহা একেবারে ছাড়িয়া দিয়া গায়ে পড়িয়া তাহাকে অস্বাভাবিক সন্ত্রম দেখাইতে লাগিলেন। বিদায়ের পূর্বে স্বচরিতা ব্যথিতচিত্তে বেশি করিয়াই বরদাসুন্দরীর গৃহকার্ষে যোগ দিতে চেষ্টা করিতেছিল, নানা উপলক্ষ্যে তাহার কাছে কাছে ফিরিতেছিল, কিন্তু বরদাসুন্দরী যেন পাছে তাহার অসম্মান ঘটে এইরূপ ভাব দেখাইয়া তাহাকে দূরে ঠেকাইয়া রাখিতেছিলেন। এতকাল যাহাকে মা বলিয়া যাহার কাছে স্বচরিতা মানুষ হইয়াছে আজ বিদায় লইবার সময়ও তিনি যে