পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8›ማ বিনয় কাগজে ওই আইনের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে আলোচনা করিয়াছে । আজ সেই সিভিল বিবাহ স্বীকার করিয়া বিনয় নিজেকে ‘হিন্দু নয়’ বলিয়া ঘোষণা করিবে এও তো বড়ো শক্ত কথা । বিনয় হিন্দুসমাজে থাকিয়া ললিতাকে বিবাহ করিবে এ প্রস্তাব পরেশ মনের মধ্যে গ্রহণ করিতে পারিলেন না । দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বিনয় উঠিয়া দাড়াইল এবং উভয়কে নমস্কার করিয়া কহিল, “আমাকে মাপ করবেন, আমি আর অপরাধ বাড়াব না ।” বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। সিড়ির কাছে আসিয়া দেখিল সম্মুখের বারানায় এক কোণে একটি ছোটো ডেস্ক, লইয়া ললিত একলা বসিয়া চিঠি লিখিতেছে। পায়ের শব্দে চোখ তুলিয়া ললিত বিনয়ের মুখের দিকে চাহিল । সেই তাহার ক্ষণকালের দৃষ্টিটুকু বিনয়ের সমস্ত চিত্তকে এক মুহূর্তে মথিত করিয়া তুলিল। বিনয়ের সঙ্গে তো ললিতার নূতন পরিচয় নয়— কতবার সে তাহার মুথের দিকে চোখ তুলিয়াছে, কিন্তু আজ তাহার দৃষ্টির মধ্যে কী রহস্ত প্রকাশ হইল ? স্বচরিত। ললিতার একটি মনের কথা জানিয়াছে— সেই মনের কথাটি আজ ললিতার কালে। চোখের পল্লবের ছায়ায় করুণায় ভরিয়া উঠিয়া একখানি সজল স্নিগ্ধ মেঘের মতো বিনয়ের চোখে দেখা দিল । বিনয়েরও এক মুহূর্তের চাহনিতে তাহার হৃদয়ের বেদন বিদ্যুতের মতো ছুটিয়া গেল ; সে ললিতাকে নমস্কার করিয়া বিনা সম্ভাষণে গিড়ি দিয়া নামিয়া চলিয়া গেল । (2○ গোরা জেল হইতে বাহির হইয়াই দেখিল পরেশবাবু এবং বিনয় দ্বারের বাহিরে তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছেন । এক মাস কিছু দীর্ঘকাল নহে। এক মাসের চেয়ে বেশিদিন গোরা আত্মীয়বন্ধুদের নিকট হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া ভ্রমণ করিয়াছে, কিন্তু জেলের এক মাস বিচ্ছেদ হইতে বাহির হইয়াই সে যখন পরেশ ও বিনয়কে দেখিল তখন তাহার মনে হইল যেন পুরাতন বান্ধবদের পরিচিত সংসারে সে পুনর্জন্ম লাভ করিল। সেই রাজপথে খোলা আকাশের নীচে প্রভাতের আলোকে পরেশের শাস্ত স্নেহপূর্ণ স্বভাবসৌম্য মুখ দেখিয়া সে যেমন ভক্তির আনন্দে তাহার পায়ের ধুলা লইল এমন আর কোনোদিন করে নাই। পরেশ তাহার সঙ্গে কোলাকুলি করিলেন । বিনয়ের হাত ধরিয়া গোরা হালিয়া কহিল, "বিনয়, ইস্কুল থেকে আরম্ভ করে একসঙ্গেই তোমার সঙ্গে সমস্ত শিক্ষা লাভ করে এসেছি, কিন্তু এই বিদ্যালয়টাতে তোমার চেয়ে ফাকি দিয়ে এগিয়ে নিয়েছি।”