পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ළුෆ রবীন্দ্র-রচনাবলী আমাদের কাজে উৎসর্গ-করা এবং যাহার চিরসহিষ্ণু ক্ষমাপূর্ণ প্রেম অক্ষয় দানরূপে আমরা ঈশ্বরের কাছ হইতে লাভ করিয়াছি, সেই লক্ষ্মীরই একটি প্রকাশকে গোরা তাহার মাতার পার্থে প্রত্যক্ষ আসীন দেখিয়া গভীর আনন্দে ভরিয়া উঠিল । তাহার মনে হইতে লাগিল, এই লক্ষ্মীর দিকে আমরা তাকাই নাই, ইহাকেই আমরা সকলের পিছনে ঠেলিয়া রাখিয়াছিলাম— আমাদের এমন দুৰ্গতির লক্ষণ আর কিছুই নাই । গোরার তখন মনে হইল— দেশ বলিতেই ইনি, সমস্ত ভারতের মর্মস্থানে প্রাণের নিকেতনে শতদল পদ্মের উপর ইনি বসিয়া আছেন, আমরাই ইহার সেবক । দেশের দুৰ্গতিতে ইহারই অবমাননা, সেই অবমাননায় উদাসীন আছি বলিয়াই আমাদের পৌরুষ আজ লজ্জিত । গোরা নিজের মনে নিজে আশ্চর্য হইয়া গেছে । যতদিন ভারতবর্ষের নারী তাহার অনুভবগোচর ছিল না ততদিন ভারতবর্ষকে সে যে কিরূপ অসম্পূর্ণ করিয়া উপলব্ধি করিতেছিল ইতিপূর্বে তাহা সে জানিতই না । গোরার কাছে নারী যখন অত্যস্ত ছায়াময় ছিল তখন দেশ সম্বন্ধে তাহার যে কর্তব্যবোধ ছিল তাহাতে কী একটা অভাব ছিল । যেন শক্তি ছিল, কিন্তু তাহাতে প্রাণ ছিল না । যেন পেশী ছিল, কিন্তু স্নায়ু ছিল না । গোরা এক মুহুর্তেই বুঝিতে পারিল যে, নারীকে যতই আমরা দূর করিয়া ক্ষুদ্র করিয়া জানিয়াছি আমাদের পৌরুষও ততই শীর্ণ হইয়া মরিয়াছে। তাই গোরা যখন স্বচরিতাকে কহিল "আপনি এসেছেন", তখন সেটা কেবল একটা প্রচলিত শিষ্ট্রসম্ভাষণরূপে তাহার মুখ হইতে বাহির হয় নাই— তাহার জীবনের একটি নূতনলন্ধ আনন্দ ও বিস্ময় এই অভিবাদনের মধ্যে পূর্ণ হইয়া ছিল। কারাবাসের কিছু কিছু চিহ্ন গোরার শরীরে ছিল । পূর্বের চেয়ে সে অনেকটা রোগ হয়ে গেছে । জেলের অল্পে তাহার অশ্রদ্ধা ও অরুচি থাকাতে এই এক মাস কাল সে প্রায় উপবাস করিয়া ছিল তাহার উজ্জল শুভ্র বর্ণও পূর্বের চেয়ে কিছু স্নান হইয়াছে। তাহার চুল অভ্যস্ত ছোটাে করিয়া ছাটা হওয়াতে মুখের কৃশতা আরও বেশি করিয়া দেখা যাইতেছে । গোরার দেহের এই শীর্ণতাই স্বচরিতার মনে বিশেষ করিয়া একটি বেদনাপূর্ণ সন্ত্রম জাগাইয়া দিল । তাহার ইচ্ছা করিতে লাগিল প্ৰণাম করিয়া গোরার পায়ের ধূলা গ্রহণ করে। যে উদ্দীপ্ত আগুনের ধোওয়া এবং কাঠ আর দেখা যায় না গোরা সেই বিশুদ্ধ অগ্নিশিখাটির মতো তাহার কাছে প্রকাশ পাইল । একটি করুণামিশ্রিত ভক্তির আবেগে স্বচরিতার বুকের ভিতরটা কঁাপিতে লাগিল। তাহার মুখ দিয়া কোনো কথা বাহির হইল না।