পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

89y রবীন্দ্র-রচনাবলী ইহা বিনয়ের কাছে অসহ বোধ হইল। বিনয়কে তর্ক করিবার অধিকার হইতে বঞ্চিত করিলে বিনয়ের পক্ষে গুরুতর শাস্তি হয় । কারণ, বিনয় জানে সে তর্ক করিতে পারে, কথা গুছাইয়া বলিতে এবং কোনো-একটা পক্ষ সমর্থন করিতে তাহার অসামান্ত ক্ষমতা । কিন্তু ললিতা যখন তাহার সঙ্গে লড়াই করিয়াছে তখন তাহাকে কোনোদিন যুক্তি প্রয়োগ করিবার অবকাশ দেয় নাই, আজও সে অবকাশ তাহার ঘটিবে না। সেই খবরের কাগজখানা পড়িয়া ছিল । বিনয় চঞ্চলতার আক্ষেপে সেটা টানিয়া লইয়া হঠাৎ দেখিল এক জায়গায় পেনসিলের দাগ দিয়া চিহ্নিত। পড়িল, এবং বুঝিল এই আলোচনা এবং নীতি-উপদেশ তাহদের দুই জনকেই উপলক্ষ্য করিয়া । ললিতা তাহার সমাজের লোকের কাছে প্রতিদিন যে কিরূপ অপমানিত হইতেছে তাহা বিনয় স্পষ্ট বুঝিতে পারিল । অথচ এই অবমাননা হইতে বিনয় তাহাকে রক্ষণ করিবার কোনো চেষ্টা করিতেছে না, কেবল সমাজতত্ত্ব লইয়া স্বক্ষ তর্ক করিতে উদ্যত হইয়াছে, ইহাতে ললিতার মতো তেজস্বিনী রমণীর কাছে সে যে অবজ্ঞা ভাজন হইবে তাহা বিনয়ের কাছে সমুচিত বলিয়াই বোধ হইল । সমাজকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিতে ললিতার যে কিরূপ সাহস তাহা স্মরণ করিয়া এবং এই দৃপ্ত নারীর সঙ্গে নিজের তুলনা করিয়া সে লজ্জা অনুভব করিতে লাগিল । স্নান সারিয়া এবং সতীশকে আহার করাইয়। ইস্কুলে পাঠাইয়া সুচরিতা যখন বিনয়ের কাছে আসিল তখন বিনয় নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছে। স্বচরিতা পূর্বপ্রসঙ্গ উত্থাপন করিল না। বিনয় অল্প আহার করিতে বসিল, কিন্তু তংপূর্বে গণ্ড,য করিল না । * হরিমোহিনী কছিলেন, "আচ্ছা বাছা, তুমি তো হিন্ডুয়ানির কিছুই মান ন!— তা হলে তুমি ব্রাহ্ম হলেই বা দোষ কী ছিল ?” বিনয় মনে মনে কিছু আহত হইয়া কহিল, "হিদুয়ানিকে যেদিন কেবল ছোওয়াখাওয়ার নিরর্থক নিয়ম বলেই জানব সেদিন ব্রাহ্ম বলে, খৃস্টান বলো, মুসলমান বলে, যা হয় একটা কিছু হব । এথনো হিদুয়ানির উপর তত অশ্রদ্ধা হয় নি।” বিনয় যখন স্নচরিতার বাড়ি হইতে বাহির হইল তখন তাহার মন অত্যন্ত বিকল হইয়া ছিল। সে যেন চারিদিক হইতেই ধাক্কা খাইয়া একটা আশ্রয়হীন শূন্যের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছিল। গোরার পাশে সে আপনার পুরাতন স্থানটি অধিকার করিতে পারিতেছে না, ললিতাও তাহাকে দূরে ঠেলিয়া রাখিতেছে—এমন-কি, হরিমোহিনীর সঙ্গেও তাহার হৃদ্যতার সম্বন্ধ অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বিচ্ছিন্ন হইবার উপক্রম