পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী وان\8 আজ আর ললিতা ও বিনয়ের মধ্যে সংকোচের অবকাশ ছিল না । তাছাদের উভয়ের জীবনে যে-একটি কঠিন সংকটের আবির্ভাব হইয়াছে তাহারই আহবানে তাহারা পরস্পরের সম্বন্ধকে সহজ করিয়া ও বড়ো করিয়া দেখিল—তাহাদের মাঝখানে কোনো আবেশের বাষ্প আসিয়া রঙিন আবরণ ফেলিয়া দিল না। তাছাদের দুই জনের হৃদয় যে মিলিয়াছে এবং তাহাদের দুই জীবনের ধারা গঙ্গাযমুনার মতো একটি পুণ্যতীর্থে এক হইবার জন্ত আসন্ন হইয়াছে এ সম্বন্ধে কোনো আলোচনামাত্র না করিয়া এ কথাটি তাহারা বিনীত গম্ভীর ভাবে নীরবে অকুষ্ঠিতচিত্তে মানিয়া লইল । সমাজ তাহাদের দুই জনকে ডাকে নাই, কোনো মত তাহাদের দুই জনকে মেলায় নাই, তাহাদের বন্ধন কোনো কৃত্রিম বন্ধন নহে, এই কথা স্মরণ করিয়া তাহারা নিজেদের মিলনকে এমন একটি ধর্মের মিলন বলিয়া অনুভব করিল, যে ধর্ম অত্যস্ত বৃহৎ ভাবে সরল, যাহা কোনো ছোটো কথা লইয়া বিবাদ করে না, যাহাকে কোনো পঞ্চায়েতের পণ্ডিত বাধা দিতে পারে না। ললিতা তাহার মুখ-চক্ষু দীপ্তিমান করিয়া কহিল, আপনি যে হেঁট হইয়া নিজেকে পাটো করিয়া আমাকে গ্রহণ করিতে আসিবেন এ অগৌরব আমি সহ করিতে পারিব না। আপনি যেখানে আছেন সেইখানেই অবিচলিত হইয়া থাকিবেন এই আমি চাই ।” বিনয় কহিল, ‘আপনার যেখানে প্রতিষ্ঠা আপনিও সেখানে স্থির থাকিবেন, কিছুমাত্র আপনাকে নড়িতে হইবে না । প্রীতি যদি প্রভেদকে স্বীকার করিতে না পারে, তবে জগতে কোনো প্রভেদ কোথাও আছে কেন ? উভয়ে প্রায় বিশ মিনিট ধরিয়া যে কথাবার্তা কহিয়াছিল তাহার সারমর্মটুকু এই দাড়ায়। তাহারা হিন্দু কি ব্রাহ্ম এ কথা তাহারা ভূলিল, তাহারা যে হুই মানবাত্মা এই কথাই তাহদের মধ্যে নিষ্কম্প প্রদীপশিখার মতো জলিতে লাগিল । (? & পরেশবাবু উপাসনার পর তাহার ঘরের সম্মুখের বারান্দায় স্তব্ধ হইয়া বলিয়া ছিলেন । সুর্য সদ্য অস্ত গিয়াছে । এমন সময় ললিতাকে সঙ্গে লইয়া বিনয় সেখানে প্রবেশ করিল ও ভূমিষ্ঠ হইয়া প্ৰণাম করিয়া পরেশের পদধূলি লইল । পরেশ উভয়কে এভাবে প্রবেশ করিতে দেখিয়া কিছু বিস্মিত হইলেন । কাছে বসিতে দিবার চৌকি ছিল না, তাই বলিলেন, "চলো, ঘরে চলো।”