পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ግ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ছাড়িয়া বাচিল। এইখানে জোর করিয়া কোনো কথা বলিবার অধিকার যে গোরার নাই ইহাতে সে একপ্রকার নিশ্চিন্ত হইল । গোরা কছিল, "কাউকে ধর্মশিক্ষা দিতে পারি এমন দাবি আমার নেই। কিন্তু আমাদের দেশের লোকের ভক্তিকে তোমরা যে উপহাস করবে এও আমি কোনোদিন সহ করতে পারব না। তুমি তোমার দেশের লোককে ডেকে বলছ— তোমরা মূঢ়, তোমরা পৌত্তলিক । আমি তাদের সবাইকে আহবান করে জানাতে চাই— না, তোমরা মূঢ় নও, তোমরা পৌত্তলিক নও, তোমরা জ্ঞানী, তোমরা ভক্ত। আমাদের ধর্মতত্ত্বে ষে মহত্ত্ব আছে, ভক্তিতত্ত্বে যে গভীরতা আছে, শ্রদ্ধাপ্রকাশের দ্বারা সেইখানেই আমার দেশের হৃদয়কে আমি জাগ্রত করতে চাই । যেখানে তার সম্পদ আছে সেইখানে তার অভিমানকে আমি উদ্যত করে তুলতে চাই । আমি তার মাথা হেঁট করে দেব না ; নিজের প্রতি তার ধিক্কার জন্মিয়ে নিজের সত্যের প্রতি তাকে অন্ধ করে তুলব না, এই আমার পণ । তোমার কাছেও আজ আমি এইজন্যেই এসেছি । তোমাকে দেখে অবধি একটি নূতন কথা দিনরাত্রি আমার মাথায় ঘুরছে। এতদিন সে কথা আমি ভাবি নি। কেবলই আমার মনে হচ্ছে— কেবল পুরুষের দৃষ্টিতেই তো ভারতবর্ষ সম্পূর্ণ প্রত্যক্ষ হবেন না। আমাদের মেয়েদের চোখের সামনে যেদিন আবির্ভূত হবেন সেইদিনই তার প্রকাশ পূর্ণ হবে । তোমার সঙ্গে একসঙ্গে একদৃষ্টিতে আমি আমার দেশকে সম্মুখে দেখব এই একটি আকাঙ্ক্ষা যেন আমাকে দগ্ধ করছে । আমার ভারতবর্ষের জন্য আমি পুরুষ তো কেবলমাত্র খেটে মরতে পারি— কিন্তু তুমি না হলে প্রদীপ জেলে তাকে বরণ করবে কে ? ভারতবর্ষের সেবা স্বন্দর হবে না, তুমি যদি র্তার কাছ থেকে দূরে থাক।” 卤 হায়, কোথায় ছিল ভারতবর্ষ ! কোন স্বরে ছিল স্বচরিতা ! কোথা হইতে আসিল ভারতবর্ষের এই সাধক, এই ভাবে-ভোলা তাপস ! সকলকে ঠেলিয়া কেন সে তাহারই পাশে আসিয়া দাড়াইল ! সকলকে ছাড়িয়া কেন সে তাহাকেই আহবান করিল ! কোনো সংশয় করিল না, বাধা মানিল না । বলিল— ‘তোমাকে নহিলে চলিবে না, তোমাকে লইবার জন্য আসিয়াছি, তুমি নির্বাসিত হইয়া থাকিলে যজ্ঞ সম্পূর্ণ হইবে না । স্বচরিতার দুই চক্ষু দিয়া ঝর ঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল, কেন তাহা সে বুঝিতে পারিল না । গোরা স্বচরিতার মুখের দিকে চাহিল। সেই দৃষ্টির সম্মুখে স্বচরিতা তাহার অশ্রুবিগলিত দুই চক্ষু নত করিল না। চিস্তাবিহীন শিশিরমণ্ডিত ফুলের মতো তাহা নিতান্ত আত্মবিশ্বতভাবে গোরার মুখের দিকে ফুটিয়া রছিল।