পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8Գ> কহিলেন, “আমাদের কাছে আর ভঁাড়িয়ে কী হবে বল ? তোমার বন্ধুর খবর তো আর চাপা রইল না— ঢাক বেজে উঠেছে । এই দেখো-না ।” বলিয়া মহিম গোরার হাতে একখানা বাংলা খবরের কাগজ দিলেন । তাহাতে অদ্য রবিবারে ৰিনয়ের ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষাগ্রহণের সংবাদ উপলক্ষ্য করিয়া এক তীব্র প্রবন্ধ বাহির হইয়াছে। গোরা যখন জেলে ছিল সেই সময়ে ব্রাহ্মসমাজের কন্যাদায়গ্ৰস্ত কোনো কোনো বিশিষ্ট সভ্য এই দুর্বলচিত্ত যুবককে গোপন প্রলোভনে বশ করিয়া সনাতন হিন্দুসমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া লইয়াছে বলিয়া লেখক তাহার রচনায় বিস্তর কটুভাষা বিস্তার করিয়াছেন। গোরা যখন বলিল সে এ সংবাদ জানে না তখন মহিম প্রথমে বিশ্বাস করিলেন না, তার পরে বিনয়ের এই গভীর ছদ্মব্যবহারে বার বার বিস্ময় প্রকাশ করিতে লাগিলেন। এবং বলিয়া গেলেন, স্পষ্টবাক্যে শশিমুর্থীকে বিবাহে সম্মতি দিয়া তাহার পরেও যখন বিনয় কথা নড়চড় করিতে লাগিল তখনই আমাদের বোঝা উচিত ছিল তাহার সর্বনাশের স্বত্রপাত হইয়াছে । অবিনাশ হাপাইতে হাপাইতে আসিয়া কছিল, "গৌরমোহনবাৰু, এ কী কাণ্ড! এ যে আমাদের স্বপ্নের অগোচর ! বিনয়বাবুর শেষকালে—” অবিনাশ কথা শেষ করিতেই পারিল না । বিনয়ের এই লাঞ্ছনায় তাহার মনে এত আনন্দ বোধ হইতেছিল যে, দুশ্চিন্তার ভান করা তাহার পক্ষে দুরূহ হইয়া উঠিয়াছিল । দেখিতে দেখিতে গোরার দলের প্রধান প্রধান সকল লোকই আসিয়া জুটিল । বিনয়কে লইয়া তাহাদের মধ্যে খুব একটা উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা চলিতে লাগিল । অধিকাংশ লোকই একবাক্যে বলিল— বর্তমান ঘটনায় বিস্ময়ের বিষয় কিছুই নাই, কারণ বিনয়ের ব্যবহারে তাহারা বরাবরই একটা দ্বিধা এবং দুর্বলতার লক্ষণ দেখিয়া আসিয়াছে, বস্তুত তাহাদের দলের মধ্যে বিনয় কোনোদিনই কায়মনোবাক্যে আত্মসমর্পণ করে নাই। অনেকেই কহিল— বিনয় গোড়া হইতেই নিজেকে কোনোক্রমে গৌরমোহনের সমকক্ষ বলিয়া চালাইয়া দিতে চেষ্টা করিত ইহা তাহাদের অসছ বোধ হইত। অন্ত সকলে যেখানে ভক্তির সংকোচে গৌরমোহনের সহিত যথোচিত দূরত্ব রক্ষা করিয়া চলিত সেখানে বিনয় গায়ে পড়িয়া গোরার সঙ্গে এমন একটা মাখামাখি করিত যেন সে আর-সকলের সঙ্গে পৃথক এবং গোরার ঠিক সমশ্রেণীর লোক, গোরা তাহাকে স্নেহ করিত বলিয়াই তাহার এই অদ্ভূত স্পর্ধ সকলে সহ করিয়া যাইত— সেইপ্রকার অবাধ অহংকারেরই এইরূপ শোচনীয় পরিণাম হইয়া থাকে। ।