পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8వెe রবীন্দ্র-রচনাবলী গোরা কহিল, "ব্ৰাহ্মসমাজে বেরিয়ে গেলে তিনি এর চেয়ে আমাদের বেশি কাছে থাকতেন। তিনি হিন্দুসমাজকে অঁাকড়ে ধরে আছেন বলেই একে সব চেয়ে বেশি পীড়ন করছেন। এর চেয়ে আমাদের সমাজকে সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি দিলেই তিনি ভালো করতেন ।” স্বচরিতা মনের মধ্যে একটা কঠিন বেদনা পাইয়া কহিল, “আপনি সমাজকে এমন অতিশয় একান্ত করে দেখেন কেন ? সমাজের উপর আপনি যে এত বেশি বিশ্বাস স্থাপন করেছেন এ কি আপনার পক্ষে স্বাভাবিক ? না, অনেকটা নিজের উপর জোর প্রয়োগ করেন ?” গোরা কহিল, “এখনকার অবস্থায় এই জোর প্রয়োগ করাটাই যে স্বাভাবিক । পায়ের নীচে যখন মাটি টলতে থাকে তখন প্রত্যেক পদেই পায়ের উপর বেশি করে জোর দিতে হয় । এখন ষে চারি দিকেই বিরুদ্ধতা, সেইজন্ত আমাদের বাক্যে এবং ব্যবহারে একটা বাড়াবাড়ি প্রকাশ পায় । সেটা অস্বাভাবিক নয় ।” স্বচরিতা কহিল, "চারি দিকে যে বিরুদ্ধতা দেখছেন সেটাকে আপনি আগাগোড়া অন্যায় এবং অনাবশ্যক কেন মনে করছেন ? সমাজ যদি কালের গতিকে বাধা দেয় তা হলে সমাজকে যে আঘাত পেতেই হবে ।” গোরা কহিল, “কালের গতি হচ্ছে জলের ঢেউয়ের মতো, তাতে ডাঙাকে ভাঙতে থাকে, কিন্তু সেই ভাঙনকে স্বীকার করে নেওয়াই যে ডাঙার কর্তব্য আমি তা মনে করি নে। তুমি মনে কোরো না সমাজের ভালোমন্দ আমি কিছুই বিচার করি নে। সে-রকম বিচার করা এতই সহজ যে, এখনকার কালের ষোলো বছরের বালকও বিচারক হয়ে উঠেছে। কিন্তু শক্ত হচ্ছে সমগ্র জিনিসকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে সমগ্র ভাবে দেখতে পাওয়া ।” সুচরিতা কহিল, “শ্রদ্ধার দ্বারা আমরা কি কেবল সত্যকেই পাই ? তাতে করে মিথ্যাকেও তো আমরা অবিচারে গ্রহণ করি ? আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, আমরা কি পৌত্তলিকতাকেও শ্রদ্ধা করতে পারি ? আপনি কি এ-সমস্ত সত্য ব’লেই বিশ্বাস করেন ?” গোরা একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “আমি তোমাকে ঠিক সত্য কথাটা বলবার চেষ্টা করব। আমি গোড়াতেই এগুলিকে সত্য বলে ধরে নিয়েছি ; যুরোপীয় সংস্কারের সঙ্গে এদের বিরোধ আছে ব’লেই এবং এদের বিরুদ্ধে কতকগুলি অত্যস্ত সস্তা যুক্তি প্রয়োগ করা যায় ব’লেই আমি তাড়াতাড়ি এদের জবাব দিয়ে বসি নি। ধর্ম সম্বন্ধে আমার নিজের কোনো বিশেষ সাধনা নেই, কিন্তু সাকারপূজা এবং পৌত্তলিকতা