পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8છેર রবীন্দ্র-রচনাবলী মনের সামনে তুমি আজ যেটি দেখতে পাচ্ছ তারা একটি লোকও তার একটুও দেখে নি। তোমার মধ্যে সেই গভীর দৃষ্টিশক্তি আছে সে আমি তোমাকে দেখেই অনুভব করেছিলুম ; সেইজন্তেই আমি আমার এতকালের হৃদয়ের সমস্ত কথা নিয়ে তোমার কাছে এসেছি, আমার সমস্ত জীবনকে তোমার সামনে মেলে দিয়েছি, কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করি নি ।” স্বচরিত কহিল, “আপনি অমন করে যখন বলেন আমার মনের মধ্যে ভারি একটা ব্যাকুলত বোধ হয় । আমার কাছ থেকে আপনি কী আশা করছেন, আমি তার কী দিতে পারি, আমাকে কী কাজ করতে হবে, আমার মধ্যে যে-একটা ভাবের আবেগ আসছে তার প্রকাশ যে কী-রকম আমি কিছুই বুঝতে পারছি নে। আমার কেবলই ভয় হতে থাকে আমার উপরে আপনি যে বিশ্বাস রেখেছেন সে পাছে সমস্তই ভুল বলে একদিন আপনার কাছে ধরা পড়ে ।” গোরা মেঘগম্ভীরকণ্ঠে কহিল, "সেখানে ভুল কোথাও নেই । তোমার ভিতরে যে কতবড়ো শক্তি আছে সে আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব । তুমি কিছুমাত্র উৎকণ্ঠা মনে রেখো না— তোমার যে যোগ্যতা সে প্রকাশ করে তোলবার ভার আমার উপরে রয়েছে, আমার উপরে তুমি নির্ভর করে ।” স্বচরিতা কোনো কথা কহিল না, কিন্তু নির্ভর করিতে তাহার যে কিছুই বাকি নাই এই কথাটি নি:শবে ব্যক্ত হইল। গোরাও চুপ করিয়া রহিল, ঘরে অনেক ক্ষণ কোনো শব্দই রহিল না। বাহিরে গলিতে পুরানো-বাসন-ওয়ালা পিতলের পাত্রে ঝন ঝন শব্দ করিয়া দ্বারের সম্মুখ দিয়া হাকিতে হাকিতে চলিয়া গেল । হরিমোহিনী তাহার পুজাহিক শেষ করিয়া পাকশালায় যাইতেছিলেন। স্বচরিতার নিঃশব্দ ঘরে যে কোনো লোক আছে তাহা তাহার মনেও হয় নাই ; কিন্তু ঘরের দিকে হঠাৎ চাহিয়া হরিমোহিনী যখন দেখিলেন স্বচরিতা ও গোরা চুপ করিয়া বলিয়া ভাবিতেছে, উভয়ে কোনোপ্রকার শিষ্টালাপমাত্রও করিতেছে না, তখন এক মুহূর্তে র্তাহার ক্রোধের শিখা ব্ৰহ্মরন্ধ পর্যন্ত যেন বিদ্যুদবেগে জলিয়া উঠিল। আত্মসম্বরণ করিয়া তিনি দ্বারে দাড়াইয়া ভাকিলেন, “রাধারানী!” স্বচরিতা উঠিয়া তাহার কাছে জাগিলে তিনি মৃদুস্বরে কছিলেন, “আজ একাদশী, আমার শরীর ভালো নেই, ষাও তুমি রান্নাঘরে গিয়ে উনানটা ধরাও গে— আমি ততক্ষণ গৌরবাবুর কাছে একটু বলি ।” স্বচরিতা মাসির ভাব দেখিয়া উদবিগ্ন হইয় রান্নাঘরে চলিয়া গেল। হরিমোহিনী ধরে প্রবেশ করিতে গোরা তাহাকে প্রণাম করিল। তিনি কোনো কথা না কহিয়া