পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8ቖግ সমস্ত মান্ত বন্ধুদের চেয়ে এরা দুজনেই তোমাদের কাছে বড়ো হয়ে উঠেছে। তার ফল কী হয়েছে দেখতে পাচ্ছি ? আমি কি প্রথম থেকেই বার বার সাবধান করে দিই নি ? আজ কী হল ? অাজ ললিতাকে কে নিবৃত্ত করবে ? তুমি ভাবছ ললিতার উপর দিয়েই বিপদের অবসান হয়ে গেল । তা নয়। আমি আজ তোমাকে সাবধান করে দিতে এসেছি । এবার তোমার পালা । আজ ললিতার দুর্ঘটনায় তুমি নিশ্চয়ই মনে মনে অনুতাপ করছ, কিন্তু এমন দিন অনতিদূরে এসেছে যেদিন নিজের অধঃপতনে তুমি অমৃতাপমা ও করবে না । কিন্তু, স্বচরিতা, এখনো ফেরবার সময় আছে। একবার ভেবে দেখো, এক দিন কতবড়ো মহৎ আশার মধ্যে আমরা দুজনে মিলেছিলুম— আমাদের সামনে জীবনের কর্তব্য কী উজ্জল ছিল, ব্রাহ্মসমাজের ভবিষ্যৎ কী উদারভাবেই প্রসারিত হয়েছিল— আমাদের কত সংকল্প ছিল এবং কত পাথেয় আমরা প্রতিদিন সংগ্রহ করেছি ! সে-সমস্তই কি নষ্ট হয়েছে মনে কর ? কখনোই না । আমাদের সেই আশার ক্ষেত্র আজও তেমনি প্রস্তুত হয়ে আছে। একবার মুখ ফিরিয়ে কেবল চাও । একবার ফিরে এস ” তখন ফুটন্ত তেলের মধ্যে অনেকখানি শাক-তরকারি ছ্যাক্ ছ্যাক্ করিতেছিল এবং খোস্ত দিয়া স্বচরিতা তাহাকে বিধিমতে নাড়া দিতেছিল ; যখন হারানবাবু র্তাহার আহবানের ফল জানিবার জন্য চুপ করিলেন তখন স্বচরিতা আগুনের উপর হইতে কড়া নীচে নামষ্টিয়া মুখ ফিরাইল এবং দৃঢ়স্বরে কহিল, “আমি হিন্দু।” হারানবাবু একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া কহিলেন, "তুমি হিন্দু!” স্বচরিতা কছিল, “হা, আমি হিন্দু।” বলিয়া কড়া আবার উনানে চড়াইয়া সবেগে পোস্তা-চালনায় প্রবৃত্ত হইল । হারানবাবু ক্ষণকাল ধাক্কা সামলাইয়া লইয়া তীব্রম্বরে কছিলেন, "গৌরমোহনবাৰু তাই বুঝি, সকাল নেই, সন্ধ্যা নেই, তোমাকে দীক্ষা দিচ্ছিলেন ?” স্বচরিতা মুখ না ফিরাইয়াই কহিল, “হা, আমি তার কাছ থেকেই দীক্ষা নিয়েছি, তিনিই আমার গুরু ।” হারানবাবু এক কালে নিজেকেই স্বচরিতার গুরু বলিয়া জানিতেন। আজ যদি স্বচরিতার কাছে তিনি শুনিতেন যে, সে গোরাকে ভালোবাসে তাহাতে তাহার তেমন কষ্ট হুইত না, কিন্তু তাহার গুরুর অধিকার আজ গোরা কাড়িয়া লইয়াছে স্বচরিতার মুখে তাহাকে এ কথা শেলের মতো বাজিল । তিনি কছিলেন, “তোমার গুরু যতবড়ো লোকই হোন-না কেন, তুমি কি মনে কর হিন্দুসমাজ তোমাকে গ্রহণ করবে ?”