পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 曹 8SS স্বচরিতা সশব্দে রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করিয়া মেজের উপর বসিয়া পড়িল এবং মুখের মধ্যে আঁচলের কাপড় গুজিয়া উচ্ছ্বলিত ক্ৰন্দনের শস্যকে প্রাণপণে নিরুদ্ধ করিল। হারানবাবু মুখ কালী করিয়া বাহির হইয়া গেলেন। হরিমোহিনী উভয়ের কথোপকথন সমস্ত শুনিয়াছিলেন । আজ তিনি স্বচরিতার মুখে যাহা শুনিলেন তাহা তাহার আশার অতীত। তাহার বক্ষ স্ফীত হইয়া উঠিল, তিনি কহিলেন, ‘হবে না ? আমি যে একমনে আমার গোপীবল্লভের পূজা করিয়া আসিলাম লে কি সমস্তই বৃথা যাইবে!’ হরিমোহিনী তৎক্ষণাৎ তাহার পূজাগৃহে গিয়া মেজের উপরে সাষ্টাঙ্গে লুটাইয়া তাহার ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন এবং আজ হইতে ভোগ আরও বাড়াইয়া দিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুত হইলেন । এতদিন তাহার পূজা শোকের সানারূপে শাস্তভাবে ছিল, আজ তাহা স্বার্থের সাধন-রূপ ধরিতেই অত্যন্ত উগ্র উত্তপ্ত ক্ষুধাতুর হইয়া উঠিল । VHම් স্বচরিতার সম্মুখে গোরা যেমন করিয়া কথা কহিয়াছে এমন আর কাহারও কাছে কহে নাই। এতদিন সে তাহার শ্রোতাদের কাছে নিজের মধ্য হইতে কেবল বাক্যকে, মতকে, উপদেশকে বাহির করিয়া আসিয়াছে— আজ স্বচরিতার সম্মুখে সে নিজের মধ্য হইতে নিজেকেই বাহির করিল। এই আত্মপ্রকাশের আনন্দে, শুধু শক্তিতে নহে, একটা রসে তাহার সমস্ত মত ও সংকল্প পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। একটি সৌন্দর্যই তাহার জীবনকে বেষ্টন করিয়া ধরিল । তাহার তপস্যার উপর যেন সহসা দেবতারা অমুত বর্ষণ করিলেন । এই আনন্দের আবেগেই গোরা কিছুই না ভাবিয়া কয়দিন প্রত্যহই স্বচরিতার কাছে আসিয়াছে, কিন্তু আজ হরিমোহিনীর কথা শুনিয়া হঠাৎ তাহার মনে পড়িয়া গেল, অনুরূপ মুগ্ধতায় বিনয়কে সে একদিন যথেষ্ট তিরস্কার ও পরিহাস করিয়াছে। আজ যেন নিজের অজ্ঞাতসারে নিজেকে সেই অবস্থার মধ্যে দাড়াইতে দেখিয়া সে চমকিয়া উঠিল। অস্থানে অলঙ্কৃত নিত্রিত ব্যক্তি ধাক্কা খাইলে যেমন ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া পড়ে গোরা সেইরূপ নিজের সমস্ত শক্তিতে নিজেকে সচেতন করিয়া তুলিল। গোরা বরাবর এই কথা প্রচার করিয়া আসিয়াছে যে, পৃথিবীতে অনেক প্রবল জাতির একেবারে ধ্বংস হইয়াছে ; ভারত কেবলমাত্র সংযমেই, কেবল দৃঢ়ভাবে নিয়ম পালন করিরাই, এত শতাব্দীর প্রতিকূল সংঘাতেও আজ পর্যন্ত