পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

( S ૨ রবীন্দ্র-রচনাবলী স্বচরিতা ললিতার কপোলের উপর কপোল রাখিয়া কহিল, “কাউকে দেব না, কাউকে দেব না।” ললিত কহিল, “কাউকে না ? একেবারে কাউকেই না ?” স্বচরিতা শুধু মাথা নাড়িল । ললিতা তখন একটু সরিয়া বসিয়া কহিল, “দেখো ভাই স্থচিদিদি, তুমি তো ভাই জান, তুমি আর-কাউকে আদর করলে আমি কোনো দিন সইতে পারতুম না। এতদিন আমি তোমাকে বলি নি, আজ বলছি— যখন গৌরমোহনবাবু আমাদের বাড়ি আসতেন— না দিদি, অমন করলে চলবে না, আমার যা বলবার আছে আমি তা আজ বলবই— তোমার কাছে আমি কোনো দিন কিছুই লুকোই নি, কিন্তু কেন জানি নে ওই একটা কথা আমি কিছুতেই বলতে পারি নি, বরাবর সেজন্য আমি কষ্ট পেয়েছি। সেই কথাটি না বলে আমি তোমার কাছ থেকে বিদায় হয়ে যেতে পারব না। যখন গৌরমোহনবাবু আমাদের বাড়ি আসতেন আমার ভারি রাগ হত— কেন রাগভুম ? তুমি মনে করেছিলে কিছু বুঝতে পারি নি ? আমি দেখেছিলুম তুমি আমার কাছে তার নামও করতে না, তাতে আমার আরও মনে রাগ হত। তুমি যে আমার চেয়ে তাকে ভালোবাসবে এ আমার অসহ বোধ হত— না ভাই দিদি, আমাকে বলতে দিতে হবে— সেজন্যে যে আমি কত কষ্ট পেয়েছি সে আর তোমাকে কী বলব ! আজও তুমি আমার কাছে সে কথা কিছু বলবে না সে আমি জানি— তা নাই বললে— আমার আর রাগ নেই— আমি যে কত খুশি হব ভাই, যদি তোমার—” স্বচরিতা তাড়াতাড়ি ললিতার মুখে হাত চাপা দিয়া কহিল, “ললিতা, তোর পায়ে পড়ি ভাই, ও কথা মুখে আনিল নে ! ও-কথা শুনলে আমার মাটিতে মিশিয়ে যেতে ইচ্ছা করে ।” ললিতা কহিল, “কেন ভাই, তিনি কি—” স্বচরিতা ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিল, “না না না! পাগলের মতো কথা বলিল নে ললিতা ! যে কথা মনে করা যায় না সে কথা মুখে আনতে নেই।” ললিতা স্বচরিতার এই সংকোচে বিরক্ত হইয়া কহিল, “এ কিন্তু, ভাই, তোমার বাড়াবাড়ি। আমি খুব লক্ষ্য করে দেখেছি আর আমি তোমাকে নিশ্চয় বলতে পারি—” স্বচরিতা ললিতার হাত ছাড়াইয়া লইয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। ললিতা তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিয়া গিয়া তাহাকে ধরিয়া আনিয়া কছিল, “আচ্ছা, আচ্ছা, আর আমি বলব না।” স্বচরিতা কহিল, “কোনোদিন না !”