পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা Q)○ ললিত কহিল, “অতবড়ো প্রতিজ্ঞ করতে পারব না । যদি আমার দিন আসে তো বলব, নইলে নয়, এইটুকু কথা দিলুম।” এ কয়দিন হরিমোহিনী ক্রমাগতই স্বচরিতাকে চোখে চোখে রাখিতেছিলেন, তাহার কাছে কাছে ফিরিতেছিলেন, স্বচরিতা তাহা বুঝিতে পারিয়াছিল এবং হরিমোহিনীর এই সন্দেহপূর্ণ সতর্কতা তাহার মনের উপর একটা বোঝার মতে চাপিয়া ছিল । ইহাতে ভিতরে ভিতরে সে ছট্‌ফট্‌ করিতেছিল, অথচ কোনো কথা বলিতে পারিতেছিল না। আজ ললিতা চলিয়া গেলে অত্যস্ত ক্লাস্ত মন লইয়া সুচরিতা টেবিলের উপরে দুই হাতের মধ্যে মাথা রাখিয়া কাদিতেছিল । বেহার ঘরে আলো দিতে আসিয়াছিল তাহাকে নিষেধ করিয়া দিয়াছে । তখন হরিমোহিনীর সায়ংসন্ধ্যার সময় । তিনি উপর হইতে ললিতাকে চলিয়া যাইতে দেখিয়া অসময়ে নামিয়া আসি এবং স্বচরিতার ঘরে প্রবেশ করিয়াই ডাকিলেন, “রাধারানী !” স্বচরিতা গোপনে চোখ মুছিয়া, তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাড়াইল । হরিমোহিনী কছিলেন, "কী হচ্ছে ?” স্বচরিতা তাহার কোনো উত্তর করিল না । হরিমোহিনী কঠোর স্বরে কহিলেন, "এ-সমস্ত কী হচ্ছে আমি তো কিছু বুঝতে পারছি নে ৷” স্বচরিতা কহিল, "মালি, কেন তুমি দিনরাত্রি আমার উপরে এমন করে দৃষ্টি রেখেছ ?” হরিমোহিনী কহিলেন, "কেন রেখেছি তা কি বুঝতে পার না ? এই-যে খাওয়াদাওয়া নেই, কান্নাকাটি চলছে, এ-সব কী লক্ষণ ? আমি তো শিশু না, আমি কি এইটুকু বুঝতে পারি নে ?” স্বচরিত কহিল, “মালি, আমি তোমাকে বলছি তুমি কিছুই বোঝ নি। তুমি এমন ভয়ানক অন্যায় ভুল বুঝছ যে, সে প্রতি মুহূর্তে আমার পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠছে।” হরিমোহিনী কছিলেন, “বেশ তো ভুল যদি বুঝে থাকি তুমি ভালো করে বুঝিয়েই বলো-না ।” স্বচরিতা দৃঢ়বলে সমস্ত সংকোচ অধ:কৃত করিয়া কহিল, “আচ্ছা, তবে বলি । আমি আমার গুরুর কাছ থেকে এমন একটি কথা পেয়েছি যা আমার কাছে নতুন, সেটিকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করতে খুব শক্তির দরকার, আমি তারই অভাব বোধ করছি— আপনার সঙ্গে কেবলই লড়াই করে পেরে উঠছি নে । কিন্তু, মাসি, তুমি আমাদের সম্বন্ধকে বিকৃত করে দেখেছ, তুমি তাকে অপমানিত করে বিদায় করে দিয়েছ, তুমি