পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(१२० রবীন্দ্র-রচনাবলী হস্তে র্তাহার পত্র আসা চাই– সেইদিন আলোচনা হইয়া অধিকাংশের মতে চূড়ান্ত নিম্পত্তি হইবে । পরেশ চিঠিখানি লইয়া পকেটে রাখিলেন। স্বচরিতা তাহার স্নিগ্ধ হস্তে র্তাহার ডান হাতখানি ধরিয়া নিঃশব্দে র্তাহার সঙ্গে সঙ্গে বেড়াইতে লাগিল । ক্রমে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনীভূত হইয়া আসিল, বাগানের দক্ষিণ পাশ্বের গলিতে রাস্তার একটি আলো জলিয়া উঠিল । স্বচরিতা মুকুকণ্ঠে কহিল, “বাবা, তোমার উপাসনার সময় হয়েছে, আমি তোমার সঙ্গে আজ উপাসনা করব।” এই বলিয়া স্বচরিতা হাত ধরিয়া তাহাকে র্তাহার উপাসনার নিভৃত ঘরটির মধ্যে লইয়া গেল— সেখানে যথানিয়মে আসন পাতা ছিল এবং একটি মোমবাতি জলিতেছিল। পরেশ আজ অনেক ক্ষণ পর্যন্ত নীরবে উপাসনা করিলেন । অবশেষে একটি ছোটো প্রার্থনা করিয়া তিনি উঠিয়া আসিলেন । বাহিরে আসিতেই দেখিলেন, উপাসনা-ঘরের দ্বারের কাছে বাহিরে ললিতা ও বিনয় চুপ করিয়া বসিয়া আছে। তাহাকে দেখিয়াই তাহারা দুই জনে প্রণাম করিয়া তাহার পায়ের ধুলা লইল । তিনি তাহাদের মাথায় হাত রাখিয়া মনে মনে আশীৰ্বাদ করিলেন । সুচরিতাকে কহিলেন, “মা, আমি কাল তোমাদের বাড়িতে যাব, আঞ্জ আমার কাজটা সেরে আসি গে।” বলিয়া তাহার ঘরে চলিয়া গেলেন । তখন সুচরিতার চোখ দিয়া জল পড়িতেছিল । সে নিস্তব্ধ প্রতিমার মতো নীরবে বারান্দায় অন্ধকারে দাড়াইয়া রহিল। ললিতা এবং বিনয়ও অনেক ক্ষণ কিছু কথা কহিল না । স্বচরিতা যখন চলিয়া যাইবার উপক্রম করিল বিনয় তখন তাহার সম্মুখে আলিয়া মুদুম্বরে কহিল, “দিদি, তুমি আমাদের আশীৰ্বাদ করবে না ?” এই বলিয়া ললিতাকে লইয়া স্বচরিতাকে প্রণাম করিল ; স্বচরিত অশ্রীরুদ্ধকণ্ঠে যাহা বলিল তাহা তাহার অন্তর্যামীই শুনিতে পাইলেন । পরেশবাবু তাহার ঘরে আসিয়া ব্রাহ্মসমাজ-কমিটির নিকট পত্র লিখিলেন ; তাহাতে লিখিলেন— 'ললিতার বিবাহ আমাকেই সম্পাদন করিতে হইবে । ইহাতে আমাকে যদি ত্যাগ করেন তাহাতে আপনাদের অন্যায় বিচার হইবে না। এক্ষণে ঈশ্বরের কাছে আমার এই একটিমাত্র প্রার্থনা রহিল তিনি আমাকে সমস্ত সমাজের আশ্রয় হইতে বাহির করিয়া লইয়া তাঁহারই পদপ্রাস্তে স্থান দান করুন।’