পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা «ՀԳ মুখে চক্ষে, ভাবে ভঙ্গীতে, কথায় ব্যবহারে এই অভাবনীয় পরিবর্তনের লক্ষণ দেখিয়া আনন্দময়ী একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেলেন এবং স্বচরিতার জন্য র্তাহার স্নেহকোমল হৃদয়ে অত্যস্ত ব্যথা বোধ করিতে লাগিলেন । এমন যে একটা সংকট প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে তাহা জানিলে তিনি কখনোই স্বচরিতাকে ডাকিতে আসিতেন না । এখন কী করিলে স্বচরিতাকে আঘাত হইতে বাচাইতে পারিবেন সে র্তাহার পক্ষে একটা সমস্যার বিষয় হইয়া উঠিল । গোরার প্রতি লক্ষ করিয়া যখন হরিমোহিনী কথা কহিলেন তখন স্বচরিত মুখ নত করিয়া নীরবে ঘর হইতে উঠিয়া চলিয়া গেল । আনন্দময়ী কহিলেন, “তোমার ভয় নেই বোন ! আমি তো আগে জানতুম না। তা, আর ওকে পীড়াপীড়ি করব না । তুমিও ওকে আর কিছু বোলো না । ও আগে এক রকম করে মানুষ হয়েছে, হঠাৎ ওকে যদি বেশি চাপ দাও সে আবার সইবে না । হরিমোহিনী কহিলেন, “সে কি আমি বুঝি নে, আমার এত বয়স হল ! তোমার মুখের সামনেই বলুক-না, আমি কি ওকে কোনোদিন কিছু কষ্ট দিয়েছি। ওর যা খুশি তাই তো করছে, আমি কখনো একটি কথা কই নে— বলি, ভগবান ওকে বঁচিয়ে রাখুন সেই আমার ঢের— যে আমার কপাল, কোনদিন কী ঘটে সেই ভয়ে ঘুম হয় না ।” আনন্দময়ী যাইবার সময় সুচরিতা তাহার ঘর হইতে বাহির হইয়া তাহাকে প্রণাম করিল। আনন্দময়ী সকরুণ স্নেহে তাহাকে স্পর্শ করিয়া কহিলেন, “আমি আসব, মা, তোমাকে সব খবর দিয়ে যাব— কোনো বিঘ্ন হবে না— ঈশ্বরের আশীর্বাদে শুভকর্ম সম্পন্ন হয়ে যাবে ।” সুচরিতা কোনো কথা কহিল না । পরদিন প্রাতে আনন্দময়ী লছমিয়াকে লইয়া যখন সেই বাসাবাড়ির বহুদিনসঞ্চিত ধূলি ক্ষয় করিবার জন্য একেবারে জলপ্লাবন বাধাইয়া দিয়াছেন এমন সময় স্বচরিতা আসিয়া উপস্থিত হইল। আনন্দময়ী তাড়াতাড়ি ঝাটা ফেলিয়া দিয়া তাহাকে বুকে টানিয়া লইলেন । তার পরে ধোওয়ামোছা জিনিসপত্র-নাড়াচাড়া ও সাজানোর ধুম পড়িয়া গেল। পরেশবাবু খরচের জন্য স্বচরিতার হাতে উপযুক্ত পরিমাণ টাকা দিয়াছিলেন ; সেই তহবিল লইয়া উভয়ে মিলিয়া বার বার করিয়া কত ফর্দ তৈরি এবং তাহার সংশোধনে প্রবৃত্ত হইলেন।