পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ¢oዓ মাতৃস্নেহের এক বন্ধনে অতি নিগৃঢ়ৰূপে এই দুই চিরবন্ধু চিরদিনই পরস্পরের নিকটতম হইয়া থাকিবে । বিনয় কহিল, “ভাই, আমি তবে উঠি। নিতান্ত না যেতে পার যেয়ে না, কিন্তু মনের মধ্যে অপ্রসন্নতা রেখো না গোরা ! এই মিলনে আমার জীবন যে কতবড়ো একটা সার্থকতা লাভ করেছে, তা যদি মনের মধ্যে অনুভব করতে পার তা হলে কখনো তুমি আমাদের এই বিবাহকে তোমার সৌহৃদ্য থেকে নির্বাসিত করতে পারবে না— সে আমি তোমাকে জোর করেই বলছি।” এই বলিয়া বিনয় আসন হইতে উঠিয়া পড়িল । গোরা কহিল, “বিনয়, বোলো । তোমাদের লগ্ন তো সেই রাত্ৰে— এখন থেকেই এত তাড়া কিসের !” বিনয় গোরার এই অপ্রত্যাশিত সস্নেহ অনুরোধে বিগলিতচিত্তে তৎক্ষণাৎ বসিয়া পড়িল । তার পর অনেক দিন পরে আজ এই ভোরবেলায় দুই জনে পূর্বকালের মতো বিশ্রম্ভালাপে প্রবৃত্ত হইল। বিনয়ের হৃদয়বীণায় আজকাল যে তারটি পঞ্চম স্বরে বাধা ছিল গোরা সেই তারেই আঘাত করিল। বিনয়ের কথা আর ফুরাইতে চাহিল না । কত নিতান্ত ছোটো ছোটো ঘটনা যাহাকে সাদা কথায় লিখিতে গেলে অকিঞ্চিংকর, এমন-কি, হাস্যকর বলিয়া বোধ হইবে, তাহারই ইতিহাস বিনয়ের মুখে যেন গানের তানের মতো বারম্বার নব নব মাধুর্বে উচ্ছসিত হইয়া উঠিতে লাগিল। বিনয়ের হৃদয়ক্ষেত্রে আজকাল যে একটি আশ্চর্য লীলা চলিতেছে, তাহারই সমস্ত অপরূপ রসবৈচিত্র্য বিনয় আপনার নিপুণ ভাষায় অতি স্বল্প অথচ গভীরভাবে হৃদয়ংগম করিয়া বর্ণনা করিতে লাগিল। জীবনের একি অপূর্ব অভিজ্ঞতা ! বিনয় যে অনির্বচনীয় পদার্থটিকে হৃদয় পূর্ণ করিয়া পাইয়াছে, এ কি সকলে পায়! ইহাকে গ্রহণ করিবার শক্তি কি সকলের আছে ? সংসারে সাধারণত স্ত্রীপুরুষের যে মিলন দেখা যায়, বিনয় কহিল, তাহার মধ্যে এই উচ্চতম স্বরটি তো বাজিতে শুনা যায় না। বিনয় গোরাকে বার বার করিয়া কছিল, অন্ত সকলের সঙ্গে সে যেন তাহাদের তুলনা না করে। বিনয়ের মনে হইতেছে ঠিক এমনটি আর কখনো ঘটিয়াছে কিনা সন্দেহ । এমন যদি সচরাচর ঘটতে পারিত তবে বসন্তের এক হাওয়াতেই যেমন সমস্ত বন নব নব পুষ্পপল্লবে পুলকিত হইয়া উঠে সমস্ত সমাজ তেমনি প্রাণের হিল্লোলে চারি দিকে চঞ্চল হইয়া উঠিত। তাহা হইলে লোকে এমন করিয়া খাইৰা-দাইয়া ঘুমাইয়া দিব্য তৈলচিৰণ হইয়া কাটাইতে পারিত না । তাহা হইলে যাহার মধ্যে ষত সৌন্দর্ব ষত শক্তি আছে স্বভাবতই নানা বর্ণে নানা আকারে দিকে দিকে উন্নীলিত হইয়া উঠিত। এ যে সোনার