পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা &రిపి সামান্ত মিলন নছে, তাহা পরিপূর্ণতা, তাহার সংস্রবে সকল জিনিসেরই মূল্য বাড়িয়া যায় ; তাহা কল্পনাকে দেহ দান করে, ও দেহকে প্রাণে পূর্ণ করিয়া তোলে ; তাহা প্রাণের মধ্যে প্রাণন ও মনের মধ্যে মননকে কেবল যে দ্বিগুণিত করে তাহা নহে, তাহাকে একটি নূতন রসে অভিষিক্ত করিয়া দেয়। বিনয়ের সঙ্গে আজ সামাজিক বিচ্ছেদের দিনে বিনয়ের হৃদয় গোরার হৃদয়ের পরে একটি অর্থও একতান সংগীত বাজাইয়া দিয়া গেল। বিনয় চলিয়া গেল, বেলা বাড়িতে লাগিল, কিন্তু সে সংগীত কোনোমতেই থামিতে চাহিল না । সমুদ্রগামিনী দুই নদী একসঙ্গে মিলিলে যেমন হয়, তেমনি বিনয়ের প্রেমের ধারা আজ গোরার প্রেমের উপরে আসিয়া পড়িয়া তরঙ্গের দ্বারা তরঙ্গকে মুখরিত করিতে লাগিল। গোরা যাহাকে কোনোপ্রকারে বাধা দিয়া, আড়াল দিয়া, ক্ষীণ করিয়া নিজের অগোচরে রাখিবার চেষ্টা করিতেছিল, তাহাই আজ কুল ছাপাইয়া আপনাকে স্বম্পষ্ট ও প্রবল মূর্তিতে ব্যক্ত করিয়া দিল । তাহাকে অবৈধ বলিয়া নিনা করিবে, তাহাকে তুচ্ছ বলিয়া অবজ্ঞা করিবে, এমন শক্তি আজ গোরার রহিল না । সমস্ত দিন এমন করিয়া কাটিল ; অবশেষে অপরাহ্ল যখন সায়াহ্নে বিলীন হইতে চলিয়াছে তখন গোরা একখান চাদর পাড়িয়া লইয়। কাধের উপর ফেলিয়া পথের মধ্যে বাহির হইয়া পড়িল । গোরা কহিল, ‘যে আমারই তাহাকে আমি লইব । নহিলে পৃথিবীতে আমি অসম্পূর্ণ, আমি ব্যর্থ হইয়া যাইব । সমস্ত পৃথিবীর মাঝখানে স্বচরিতা তাহারই আহবানের জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে, ইহাতে গোরার মনে লেশমাত্র সংশয় রহিল না । আজই এই সন্ধ্যাতেই এই অপেক্ষাকে সে পূর্ণ করিবে । জনাকীর্ণ কলিকাতার রাস্তা দিয়া গোরা বেগে চলিয়া গেল । কেহই যেন, কিছুতেই যেন, তাহাকে স্পর্শ করিল না। তাহার মন তাহার শরীরকে অতিক্রম করিয়া একাগ্র হইয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে । স্বচরিতার বাড়ির সম্মুখে আসিয়া গোরা যেন হঠাৎ সচেতন হইয়া থামিয়া দাড়াইল । এতদিন আসিয়াছে কখনো দ্বার বন্ধ দেখে নাই, আজ দেখিল দরজা খোলা নহে । ঠেলিয়া দেখিল, ভিতর হইতে বন্ধ। দাড়াইয়া একটু চিন্তা করিল , তাহার পরে দ্বারে আঘাত করিয়া দুই-চারি বার শব্দ করিল। বেহার দ্বার খুলিয়া বাহির হইয়া আসিল । সে সন্ধ্যার অস্পষ্ট আলোকে গোরাকে দেখিতেই কোনো প্রশ্নের অপেক্ষা না করিয়াই কছিল, দিদিঠাকরুন বাড়িতে নাই। কোথায় ?