পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 28● যেদিন চিঠি পাইলেন, হরিমোহিনী তাহার পরদিন সকালেই পালকিতে করিয়া বেহারাকে সঙ্গে লইয়া স্বয়ং বিনয়ের বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন নীচের ঘরে স্বচরিতা ললিতা ও আনন্দময়ী রান্নাবান্নার আয়োজনে বসিয়া গেছেন। উপরের ঘরে বানান-সমেত ইংরাজী শব্দ ও তাহার বাংলা প্রতিশব্দ মুখস্থ করার উপলক্ষ্যে সতীশের কণ্ঠস্বরে সমস্ত পাড়া সচকিত হইয়া উঠিয়াছে। বাড়িতে তাহার গলার এত জোর অনুভব করা যাইত না, কিন্তু এখানে সে যে তাহার পড়াশুনায় কিছুমাত্র অবহেলা করিতেছে না ইহাই নিঃসংশয়ে প্রমাণ করিবার জন্ত তাহাকে অনেকটা উদ্যম তাহার কণ্ঠস্বরে অনাবশ্বক প্রয়োগ করিতে হইতেছে । হরিমোহিনীকে আনন্দময়ী বিশেষ সমাদরের সহিত অভ্যর্থনা করিলেন । সে সমস্ত শিষ্টাচারের প্রতি মনোযোগ না করিয়া তিনি একেবারেই কহিলেন, “আমি রাধারানীকে নিতে এসেছি ।” আনন্দময়ী কছিলেন, "তা, বেশ তো, নিয়ে যাবে, একটু বোলো ।” হরিমোহিনী কহিলেন, “না, আমার পূজা-আর্চা সমস্তই পড়ে রয়েছে, আমার আহিক সারা হয় নি— আমি এখন এখানে বসতে পারব না ।” স্বচরিতা কোনো কথা না কহিয়া অলাবুচ্ছেদনে নিযুক্ত ছিল । হরিমোহিনী তাহাকেই সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “গুনছ ? বেলা হয়ে গেল।” ললিতা এবং আনন্দময়ী নীরবে বসিয়া রহিলেন । স্বচরিতা তাহার কাজ রাখিয়া উঠিয়া পড়িল এবং কহিল “মালি, এস।” হরিমোহিনী পালকির অভিমুখে যাইবার উপক্রম করিতে স্বচরিতা তাহার হাত ধরিয়া কহিল, "এস, একবার এ ঘরে এল ” ঘরের মধ্যে লইয়া গিয়া স্বচরিতা দৃঢ়স্বরে কহিল, “তুমি যখন আমাকে নিতে এসেছ তখন সকল লোকের সামনেই তোমাকে অমনি ফিরিয়ে দেব না, আমি তোমার সঙ্গেই যাচ্ছি, কিন্তু আজ দুপুরবেলাই আমি এখানে আবার ফিরে আসব।” হরিমোহিনী বিরক্ত হইয়া কছিলেন, “এ আবার কেমন কথা ! তা হলে বলো-না কেন, এইখানেই চিরকাল থাকবে ।” সুচরিতা কহিল, "চিরকাল তো থাকতে পাব না । সেইজন্তই যতদিন ওঁর কাছে থাকতে পাই আমি ওঁকে ছাড়ব না।” এই কথায় হরিমোহিনীর গা জলিয়া গেল, কিন্তু এখন কোনো কথা বলা তিনি স্বযুক্তি বলিয়া বোধ করিলেন না। g স্বচরিত আনন্দময়ীর কাছে আসিয়া হাতমুখে কহিল, "মা, আমি তবে একবার