পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(? 8V রবীন্দ্র-রচনাবলী কৈলাস আজকালকার ছেলে, লেখাপড়া শিখেছে, তোমাদেরই মতো ও তো কিছুই মানে না, বলে ‘পাত্ৰী নিজের চক্ষে দেখব । তা তোমরা সবার সামনেই বেরোও তাই বললুম, দেখবে, সে আর বেশি কথা কী, এক দিন দেখা করিয়ে দেব।’ তা, তোমার লজ্জা হয় তো দেখা নাই হল ।” এই বলিয়া কৈলাস যে কিরূপ আশ্চর্য লেখাপড়া করিয়াছে, সে যে তাহার কলমের এক আঁচড়-মাত্রে তাহার গ্রামের পোস্ট মাস্টারকে কিরূপ বিপন্ন করিয়াছিল— নিকটবর্তী চারি দিকের গ্রামের যে-কাহারোই মামলা-মকদ্দমা করিতে হয়, দরখাস্ত লিখিতে হয়, কৈলাসের পরামর্শ ব্যতীত যে কাহারও এক পা চলিবার জো নাই— ইহা তিনি বিবৃত করিয়া বলিলেন । আর, উহার স্বভাবচরিত্রের কথা বেশি করিয়া বলাই বাহুল্য । ওর স্ত্রী মরার পর ও তো কিছুতেই বিবাহ করিতে চায় নাই ; আত্মীয়স্বজন সকলে মিলিয়া অত্যন্ত বলপ্রয়োগ করাতে ও কেবল গুরুজনের আদেশ পালন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। উপস্থিত প্রস্তাবে সম্মত করিতে হরিমোহিনীকেই কি কম কষ্ট্র পাইতে হইয়াছে ! ও কি কৰ্ণপাত করিতে চায়! ওরা যে মস্ত বংশ । সমাজে ওদের যে ভারি মান । স্বচরিতা এই মান খর্ব করিতে কিছুতেই স্বীকার করিল না । কোনোমতেই না । সে নিজের গৌরব ও স্বার্থের প্রতি দৃকপাতমাত্র করিল না। এমন-কি হিন্দুসমাজে তাহার স্থান যদি নাও হয় তথাপি সে লেশমাত্র বিচলিত হইবে না, এইরূপ তাহার ভাব দেখা গেল ! কৈলাসকে বহু চেষ্টায় বিবাহে রাজি করানোতে স্বচরিতার পক্ষে অল্প সম্মানের কারণ হয় নাই এ কথা সে মূঢ় কিছুতেই উপলব্ধি করিতে পারিল না, উলটিয়া সে ইহাকে অপমানের কারণ বলিয়া গণ্য করিয়া বসিল । আধুনিক কালের এই-সমস্ত বিপরীত ব্যাপারে হরিমোহিনী সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন । তখন তিনি মনের আক্রোশে বার বার গোরার প্রতি ইঙ্গিত করিয়া খোচা দিতে লাগিলেন। গোরা যতই নিজেকে হিন্দু বলিয়া বড়াই করুক-না কেন, সমাজের মধ্যে উহার স্থান কী ! উহাকে কে মানে ! ও যদি লোভে পড়িয়া ব্রাহ্মঘরের কোনো টাকাওয়ালা মেয়েকে বিবাহ করে তবে সমাজের শাসন হইতে ও পরিত্রাণ লাভ করিবে কিসের জোরে! তখন দশের মুখ বন্ধ করিয়া দিবার জন্ত টাকা যে সমস্ত ফুকিয়া দিতে হুইবে । ইত্যাদি । স্বচরিতা কছিল, “মালি, এ-সব কথা তুমি কেন বলছ ? তুমি জান এ-সব কথার কোনো মূল নেই।”