পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ 8br রবীন্দ্র-রচনাবলী কেবল ব্রাহ্মঘরের মেয়েদের সঙ্গে মিশিতে গিয়াই সে এই সত্য আবিষ্কার করিয়াছে তাহা নহে । গোর জনসাধারণের সঙ্গে যে মিলিতে গিয়াছিল সেখানেও একটা যেন আবর্তের মধ্যে পড়িয়া নিজেকে নিজে হারাইবার উপক্রম করিয়াছিল । কেননা, তাহার পদে পদে দয়া জন্মিতেছিল ; এই দয়ার বশে সে কেবলই ভাবিতেছিল এটা মন, এটা অন্যায়, এটাকে দূর করিয়া দেওয়া উচিত। কিন্তু এই দয়াবৃত্তিই কি ভালো-মন্দ-সুবিচারের ক্ষমতাকে বিকৃত করিয়া দেয় না ? দয়া করিবার ক্টেকিট আমাদের যতই বাড়িয়া উঠে নির্বিকারভাবে সত্যকে দেখিবার শক্তি আমাদের ততই চলিয়া যায়— প্রধূমিত করুণার কালিমা মাখাইয়া যাহা নিতান্ত ফিক তাহাকে অত্যন্ত গাঢ় করিয়া দেখি । গোরা কহিল— এইজন্যই, যাহার প্রতি সমগ্রের হিতের ভার তাহার নির্লিপ্ত থাকিবার বিধি আমাদের দেশে চলিয়া আসিয়াছে। প্রজার সঙ্গে একেবারে ঘনিষ্ঠভাবে মিশিলে তবেই যে প্রজাপালন করা রাজার পক্ষে সম্ভব হয় এ কথা সম্পূর্ণ অমূলক । প্রজাদের সম্বন্ধে রাজার যেরূপ জ্ঞানের প্রয়োজন সংস্রবের দ্বারা তাহা কলুষিত হয়। এই কারণে, প্রজারা নিজেই ইচ্ছা করিয়া তাহাদের রাজাকে দূরত্বের দ্বার বেষ্টন করিয়া রাখিয়াছে । রাজা তাহীদের সহচর হইলেই রাজার প্রয়োজন চলিয়া যাইবে । ব্রাহ্মণও সেইরূপ স্বপ্রস্থ, সেইরূপ নির্লিপ্ত। ব্রাহ্মণকে অনেকের মঙ্গল করিতে হইবে, এইজন্যই অনেকের সংসর্গ হইতে ব্রাহ্মণ বঞ্চিত । গোরা কহিল, ‘আমি ভারতবর্ষের সেই ব্রাহ্মণ ' দশজনের সঙ্গে জড়িত হইয়া, ব্যবসায়ের পক্ষে লুষ্ঠিত হইয়া, অর্থের প্রলোভনে লুব্ধ হইয়া, যে ব্রাহ্মণ শূদ্রত্বের ফাস গলায় বাধিয়া উদবন্ধনে মরিতেছে গোরা তাহাদিগকে তাহার স্বদেশের সজীব পদার্থের মধ্যে গণ্য করিল না ; তাহাদিগকে শূত্রের অধম করিয়া দেখিল, কারণ, শূদ্র আপন শূদ্ৰত্বের দ্বারাই বাচিয়া আছে, কিন্তু ইহারা ব্রাহ্মণত্বের অভাবে মুত, স্বতরাং ইহার অপবিত্র। ভারতবর্ষ ইহাদের জন্ত আজ এমন দীনভাবে অশৌচ ষাপন করিতেছে। গোরা নিজের মধ্যে সেই ব্রাহ্মণের সঞ্জীবন-মন্ত্র সাধনা করিবে বলিয়া মনকে আজ প্রস্তুত করিল। কহিল, ‘আমাকে নিরতিশয় শুচি হইতে হইবে । আমি সকলের সঙ্গে সমান ভূমিতে দাড়াইয়া নাই । বন্ধুত্ব আমার পক্ষে প্রয়োজনীয় সামগ্ৰী নহে, নারীর সঙ্গ যাহাদের পক্ষে একান্ত উপাদেয় আমি সেই সামান্তশ্রেণীর মানুষ নই, এবং দেশের ইতরসাধারণের ঘনিষ্ঠ সহবাস আমার পক্ষে সম্পূর্ণ বর্জনীয়। পৃথিবী হয়ে আকাশের দিকে বৃষ্টির জন্য যেমন তাকাইয়া আছে ব্রাহ্মণের দিকে ইহার তেমনি করিয়া তাকাইয়া আছে, আমি কাছে আসিয়া পড়িলে ইহাদিগকে বাচাইবে কে ?