পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

€6.8 রবীন্দ্র-রচনাবলী গোরা কহিল, "সমাজে তা হলে আমাকে স্বতন্ত্র হয়েই থাকতে হবে ।” কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “সে তো ভালোই ।” তাহার এই উৎসাহে গোরাকে বিস্মিত হইতে দেখিয়া কহিলেন, “এই দেখো-না, আমি কারও সঙ্গে খাই নে, নিমন্ত্রণ হলেও না । সমাজের সঙ্গে আমার যোগ কীই বা আছে ? তুমি যে-রকম সাত্বিকভাবে জীবন কাটাতে চাও তোমারও তো এইরকম পন্থাই অবলম্বন করা শ্রেয় । আমি তো দেখছি এতেই তোমার মঙ্গল ।” মধ্যাহ্নে অবিনাশকে ডাকাইয়া কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “তোমরাই বুঝি সকলে মিলে গোরাকে নাচিয়ে তুলেছ।” অবিনাশ কহিলেন, “বলেন কী, আপনার গোরাই তো আমাদের সকলকে নাচায় । বরঞ্চ সে নিজেই নাচে কম ।” কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “কিন্তু বাবা, আমি বলছি, তোমাদের ও-সব প্রায়শ্চিত্ত-টিভ হবে না। আমার ওতে একেবারেই মত নেই । এখনই সব বন্ধ করে দাও।” অবিনাশ ভাবিল, বুড়ার এ কী রকম জেদ । ইতিহাসে বড়ো বড়ো লোকের বাপরা নিজের ছেলের মহত্ত্ব বুঝিতে পারে নাই এমন দৃষ্টাস্ত ঢের আছে, কৃষ্ণদয়ালও সেই জাতেরই বাপ । কতকগুলা বাজে সন্ন্যাসীর কাছে দিনরাত না থাকিয়া কৃষ্ণদয়াল যদি র্তাহার ছেলের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করিতে পারিতেন তাহা হইলে তাহার ঢের উপকার হইত । অবিনাশ কৌশলী লোক ; যেখানে বাদপ্রতিবাদ করিয়া ফল নাই, এমন-কি, মরাল এফেক্টেরও সম্ভাবনা অল্প, সেখানে সে বৃথা বাক্যব্যয় করিবার লোক নয় । সে কহিল, “বেশ তো মশায়, আপনার যদি মত না থাকে তো হবে না। তবে কিনা, উদযোগআয়োজন সমস্তই হয়েছে, নিমন্ত্রণপত্রও বেরিয়ে গেছে— এ দিকে আর বিলম্বও নেই— তা নয় এক কাজ করা যাবে— গোরা থাকুন, সেদিন আমরাই প্রায়শ্চিত্ত করব— দেশের লোকের পাপের তো অভাব নেই ।” অবিনাশের এই আশ্বাসবাক্যে কৃষ্ণদয়াল নিশ্চিস্ত হইলেন। কৃষ্ণদয়ালের কোনো কথায় কে নোদিন গোরার বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল না । আজও সে র্তাহার আদেশ পালন করিবে বলিয়া মনের মধ্যে স্বীকার করিল না । সাংসারিক জীবনের চেয়ে বড়ো যে জীবন, সেখানে গোরা পিতামাতার নিষেধকে মান্ত করিতে নিজেকে বাধ্য মনে করে না । কিন্তু তবু আজ সমস্ত দিন তাহার মনের মধ্যে ভারি একটা কষ্ট বোধ হইতে লাগিল । কৃষ্ণদয়ালের সমস্ত কথার মধ্যে যেন কী-একটা সত্য প্রচ্ছন্ন আছে তাহার মনের ভিতরে এই রকমের একটা অস্পষ্ট ধারণ জন্মিতেছিল।