পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

&\o রবীন্দ্র-রচনাবলী গোরা, তুই যে আমার পুত্রহীনার পুত্র, তুই যে গর্ভের ছেলের চেয়ে অনেক বেশি বাবা!” গোরা তখন কৃষ্ণদয়ালের মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, "আমাকে তবে তোমরা কোথায় পেলে ?” কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “তখন মিউটিনি। আমরা এটোয়াতে । তোমার মা সিপাহিদের ভয়ে পালিয়ে এসে রাত্রে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন । তোমার বাপ তার আগের দিনেই লড়াইয়ে মারা গিয়াছিলেন । তার নাম ছিল—” গোরা গর্জন করিয়া বলিয়া উঠিল, “দরকার নেই তার নাম। আমি নাম জানতে চাই নে ৷” কৃষ্ণদয়াল গোরার এই উত্তেজনায় বিস্মিত হইয়া থামিয়া গেলেন । তার পর বলিলেন, “তিনি আইরিশম্যান ছিলেন । সেই রাত্রেই তোমার মা তোমাকে প্রসব করে মারা গেলেন । তার পর থেকেই তুমি আমাদের ঘরে মানুষ হয়েছ।” এক মুহুর্তেই গোরার কাছে তাহার সমস্ত জীবন অত্যন্ত অদ্ভূত একট। স্বপ্নের মতো হইয়া গেল । শৈশব হইতে এত বংসর তাহার জীবনের যে ভিত্তি গড়িয়া উঠিয়াছিল তাহা একেবারেই বিলীন হইয়া গেল । সে যে কী, সে যে কোথায় আছে, তাহা যেন বুঝিতেই পারিল না । তাহার পশ্চাতে অতীতকাল বলিয় যেন কোনো পদার্থই নাই এবং তাহার সম্মুখে তাহার এতকালের এমন একাগ্রলক্ষবর্তী স্বনির্দিষ্ট ভবিষ্যং একেবারে বিলুপ্ত হইয় গেছে । সে যেন কেবল এক মুহূর্ত-মাত্রের পদ্মপত্রে শিশিরবিন্দুর মতে ভাসিতেছে । তাহার মা নাই, বাপ নাই, দেশ নাই, জাতি নাই, নাম নাই, গোত্র নাই, দেবতা নাই। তাহার সমস্তই একটা কেবল 'না' । সে কী ধরিবে, কী করিবে, আবার কোথা হইতে শুরু করিবে, আবার কোন দিকে লক্ষ স্থির করিবে, আবার দিনে দিনে ক্রমে ক্রমে কর্মের উপকরণসকল কোথা হইতে কেমন করিয়া সংগ্ৰহ করিয়া তুলিবে! এই দিক্‌চিহ্নহীন অদ্ভুত শূন্তের মধ্যে গোরা নির্বাক হইয়া বসিয়া রহিল। তাহার মুখ দেখিয়া কেহ তাহাকে আর দ্বিতীয় কথাটি বলিতে সাহস করিল না । এমন সময় পরিবারের বাঙালি চিকিৎসকের সঙ্গে সাহেব-ডাক্তার আসিয়া উপস্থিত হইল । ডাক্তার যেমন রোগীর দিকে তাকাইল তেমনি গোরার দিকেও না তাকাইয়া থাকিতে পারিল না । ভাবিল, এ মানুষটা কে ! তখনো গোরার কপালে গঙ্গামুত্তিকার তিলক ছিল এবং স্বানের পরে সে যে গরদ পরিয়াছিল তাহা পরিয়াই আসিয়াছে। গায়ে জামা নাই, উত্তরীয়ের অবকাশ দিয়া তাহার প্রকাগু দেহু দেখা যাইতেছে।