পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

লোকসাহিত্য 4brఏ কাছে ছন্দের তালে তালে স্বমিষ্ট কণ্ঠে এই-সকল অসংলগ্ন অসম্ভব ঘটনা উপস্থিত করা হইয়া থাকে তাহারা বিশ্বাসও করে না, সন্দেহও করে না, তাহারা মনশ্চক্ষে স্বপ্নবং প্রত্যক্ষবং ছবি দেখিয়া যায় । বালকের ছবিও অতিশয় সহজে স্বল্লায়োজনে দেখিতে পায়। ইহার কারণ পূর্বে এক স্থলে বলিয়াছি, ইচ্ছাশক্তি সম্বন্ধে বালকের সহিত দেবতার একটা সাদৃপ্ত দেখা যায় । বালক যত সহজে ইচ্ছামাত্রই স্বজন করিতে পারে আমরা তেমন পারি না । ভাবিয়া দেখো, একটা গ্রন্থিবাধা বস্ত্রখণ্ডকে মুণ্ডবিশিষ্ট মনুষ্য কল্পনা করিয়া তাহাকে আপনার সন্তানরূপে লালন করা সামান্ত ব্যাপার নহে । আমাদের একটা মূর্তিকে মানুষ বলিয়া কল্পনা করিতে হইলে ঠিক সেটাকে মামুষের মতো গড়িতে হয়— যেখানে যতটুকু অনুকরণের ক্রটি থাকে তাহাতেই আমাদের কল্পনার ব্যাঘাত করে। বহিরজগতের জড়ভাবের শাসনে আমরা নিয়ন্ত্ৰিত ; আমাদের চক্ষে যাহা পড়িতেছে আমরা কিছুতেই তাঁহাকে অন্যরূপে দেখিতে পারি না । কিন্তু, শিশু চক্ষে যাহা দেখিতেছে তাহাকে উপলক্ষ্যমাত্র করিয়া আপন মনের মতে জিনিস মনের মধ্যে গড়িয়া লইতে পারে, মহামূর্তির সহিত বস্ত্রখণ্ডরচিত খেলনকের কোনো বৈসাদৃপ্ত তাহার চক্ষে পড়ে না, সে আপনার ইচ্ছারচিত স্বষ্টিকেই সম্মুখে জাজল্যমান করিয়া দেখে । কিন্তু তথাপি ছড়ার এই-সকল অযত্বরচিত চিত্রগুলি কেবল যে বালকের সহজ মৃজনশক্তি-স্বারা স্বজিত হইয়া উঠে তাহা নহে ; তাহার অনেক স্থানে রেখার এমন কুম্পষ্টতা আছে যে, তাহারা আমাদের সংশয়ী চক্ষেও অতি সংক্ষেপ বর্ণনায় ত্বরিতচিত্র আনিয়া উপস্থিত করে । এই ছবিগুলি একটি রেখা একটি কথার ছবি । দেশলাই যেমন এক আঁচড়ে দপ্ত করিয়া জলিয়া উঠে বালকের চিত্তে তেমনি একটি কথার টানে একটি সমগ্র চিত্র পলকের মধ্যে জাগাইয়া তুলিতে হয়। অংশ যোজনা করিয়া কিছু গড়িয়া তুলিলে চলিবে না। চিংপুরের মাঠেতে বালি চিক্‌ চিক্‌ করে । এই একটিমাত্র কথায় একটি বৃহৎ অমুর্বর মাঠ মধ্যাহের রৌদ্রালোকে আমাদের দৃষ্টপথে আসিয়া উদয় হয়। পরনে তার ডুরে শাড়ি ঘুরে পড়েছে। ডুরে শাড়ির ডোরা রেখাগুলি ঘূর্ণাঙ্গলের আবর্তধারার মতো তমুগাত্রখটিকে যেমন ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেষ্টন করিয়া ধরে তাহা ওই এক ছত্রে এক মূহূর্তে চিত্রিত হইয়া উঠিয়াছে। আবার পাঠাস্তরে আছে— পরনে তার ডুরে কাপড় উড়ে পড়েছে।