পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী 8 هوا নব নব স্নেহের ছাচে ঢালিয়া এক খুকুদেবতার কত মূর্তিই প্রতিষ্ঠা করিয়াছে— সে কখনো পাখি, কখনো চাদ, কখনো মানিক, কখনো ফুলের বন । ধনকে নিয়ে বনকে যাব, সেখানে খাব কী । নিরলে বসিয়া চাদের মুখ নিরখি । ভালোবাসার মতো এমন স্বষ্টিছাড়া পদার্থ আর কিছুই নাই। সে আরম্ভকাল হইতে এই স্থষ্টির আদি-অন্তে অভ্যস্তরে ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছে, তথাপি স্বষ্টির নিয়ম সমস্তই লঙ্ঘন করিতে চায় । সে যেন স্বষ্টির লৌহপিঞ্জরের মধ্যে আকাশের পাখি । শত সহস্ৰ বার প্রতিষেধ প্রতিরোধ প্রতিবাদ প্রতিঘাত পাইয়াও তাহার এ বিশ্বাস কিছুতেই গেল না যে, সে অনায়াসেই নিয়ম না মানিয়া চলিতে পারে । সে মনে মনে জানে আমি উড়িতে পারি, এইজন্যই সে লোহার শলাকাগুলাকে বারম্বার ভুলিয়া যায় । ধনকে লইয়া বনকে যাইবার কোনো আবশ্যক নাই, ঘরে থাকিলে সকল পক্ষেই স্ববিধা । অবশু বনে অনেকটা নিরালা পাওয়া যায় সন্দেহ নাই, কিন্তু তাহা ছাড়া আর বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না । বিশেষত নিজেই স্বীকার করিতেছে সেখানে উপযুক্ত পরিমাণে আহার্য দ্রব্যের অসদ্ভাব ঘটিতে পারে । কিন্তু তবু ভালোবাসা জোর করিয়া বলে, তোমরা কি মনে কর আমি পারি না ? তাহার এই অসংকোচ স্পর্ধাবাক্য শুনিয়া আমাদের মতো প্রবীণবুদ্ধি বিবেচক লোকেরও হঠাং বুদ্ধিভ্রংশ হইয়া যায় ; আমরা বলি, তাও তো বটে, কেনই বা না পরিবে ? যদি কোনে সংকীর্ণহৃদয় বস্তুজগংবদ্ধ সংশয়ী জিজ্ঞাসা করে, খাইবে কী। সে তৎক্ষণাং অম্লানমুখে উত্তর দেয়, ‘নিরলে বসিয়া চাদের মুখ নিরধি’ | শুনিবামাত্র আমরা মনে করি, ঠিক সংগত উত্তরটি পাওয়া গেল । অন্যের মুখে যাহা ঘোরতর স্বতঃসিদ্ধ মিথ্যা, যাহা উন্মাদের অত্যুক্তি, ভালোবাসার মুখে তাহা অবিসংবাদিত প্রামাণিক কথা । ভালোবাসার আর-একটি গুণ এই যে, সে এককে অfর করিয়া দেয় । ভিন্ন পদার্থের প্রভেদসীমা মানিতে চাহে না । পাঠক পূর্বেই তাহার উদাহরণ পাইরাছেন, দেখিয়াছেন একটা ছড়ায় কিছুমাত্র ভূমিকা না করিয়া খোকাকে অনায়াসেই পক্ষীজাতীয়ের সামিল করিয়া দেওয়া হইয়াছে— কোনো প্রাণীবিজ্ঞানবিং তাঁহাতে আপত্তি করিতে আসেন না। আবার পরমুহূর্তেই খোকাকে যখন আকাশের চক্সের অভেদ আত্মীয়রূপে বর্ণনা করা হয় তখন কোনো জ্যোতির্বিদ তাহার প্রতিবাদ করিতে সাহস করেন না । কিন্তু সর্বাপেক্ষ ভালোবাসার স্বেচ্ছাচারিত প্রকাশ পায় যখন সে আড়ম্বরপূর্বক যুক্তির অবতারণা করিয়া ঠিক শেষ মুহূর্তে তাহাকে অবজ্ঞাভরে পদাঘাত করিয়া ভাঙির ফেলে। নিয়ে তাহার একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতেছে।