পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

লোকসাহিত্য \უo (k চাদ কোথা পাব বাছা, জাদুমণি ! মাটির চাদ নয়ও গড়ে দেব। গাছের চাদ নয় ও পেড়ে দেব, তোর মতন চাদ কোথায় পাব । তুই চাদের শিরোমণি। ঘুমে রে আমার খোকামণি ৷ চাদ আয়ত্তগম্য নহে, চাদ মাটির গড়া নহে, গাছের ফল নহে, এ-সমস্তই বিশুদ্ধ যুক্তি, অকাট্য এবং নৃতন— ইহার কোথাও কোনো ছিদ্র নাই । কিন্তু এতদূর পর্যন্ত আসিয়া অবশেষে যদি খোকাকে বলিতে হয় যে, তুমিই চাদ এবং তুমি সকল চন্দ্রের শ্ৰেষ্ঠ, তবে তো মাটির চাদও সম্ভব, গাছের চাদও আশ্চর্য নহে। তবে গোড়ায় যুক্তির কথা পাড়িবার প্রয়োজন কী ছিল । এইখানে বোধ করি একটি কথা বলা নিতাস্ত অপ্রাসঙ্গিক হইবে না । স্ত্রীলোকদের মধ্যে যে বহুল পরিমাণে যুক্তিহীনতা দেখা যায় তাহা বুদ্ধিহীনতার পরিচায়ক নহে। র্তাহারা যে জগতে থাকেন সেখানে ভালোবাসারই একাধিপত্য । ভালোবাসা স্বর্গের মানুষ । সে বলে, আমার অপেক্ষ আর-কিছু কেন প্রধান হইবে ? আমি ইচ্ছা করিতেছি বলিয়াই বিশ্বনিয়মের সমস্ত বাধা কেন অপসারিত হইবে না ? সে স্বপ্ন দেখিতেছে, এখনও সে স্বগে ই আছে । কিন্তু হায়, মর্ত পৃথিবীতে স্বর্গের মতো ঘোরতর অযৌক্তিক পদার্থ আর কী হইতে পারে! তথাপি পৃথিবীতে যেটুকু স্বর্গ আছে সে কেবল রমণীতে বালকে প্রেমিকে ভাবুকে মিলিয়া সমস্ত যুক্তি এবং নিয়মের প্রতিকূল স্রোতেও ধরাতলে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। পৃথিবী যে পৃথিবীই, এ কথা তাহারা অনেক সময় তুলিয়া যায় বলিয়াই সেই ভ্রমক্রমেই পৃথিবীতে দেবলোক স্খলিত হইয়া পড়ে । ভালোবাসা এক দিকে যেমন প্রভেদসীমা লোপ করিয়া চাদে ফুলে খোকায় পাখিতে এক মুহূর্তে একাকার করিয়া দিতে পারে, তেমনি আবার আর-এক দিকে যেখানে সীমা নাই সেখানে সীমা টানিয়া দেয়, যেখানে আকার নাই সেখানে আকার গড়িয়া বলে । এপর্যন্ত কোনো প্রাণীতত্ত্ববিৎ পণ্ডিত ঘুমকে স্তন্যপায়ী অথবা অন্ত কোনো জীবশ্রেণীতে বিভক্ত করেন নাই। কিন্তু ঘুম নাকি খোকার চোখে আসিয়া থাকে, এইজন্য তাহার উপরে সর্বদাই ভালোবাসার স্বজনহন্ত পড়িয়া সেও কখন একটা মানুষ হইয়া উঠিয়াছে।