পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

লোকসাহিত্য )و جنای وسی গ্রাম্যসাহিত্য একদিন শ্রাবণের শেষে নৌকা করিয়া পাবনা রাজসাহির মধ্যে ভ্রমণ করিতেছিলাম। মাঠ ঘাট সমস্ত জলে ডুবিয়াছে । ছোটো ছোটো গ্রামগুলি জলচর জীবের ভাসমান কুলায়পুঞ্জের মতো মাঝে মাঝে জাগিয়া আছে । কুলের রেখা দেখা যায় না, শুধু জল ছলছল করিতেছে । ইহার মধ্যে যখন স্বৰ্ষ অস্ত যাইবে এমন সময়ে দেখা গেল প্রায় দশ-বারো জন লোক একখানি ভিডি বাহিয়া আসিতেছে । তাহারা সকলে মিলিয়া উচ্চকণ্ঠে এক গান ধরিয়াছে এবং দাড়ের পরিবর্তে এক-একখানি বাখারি দুই হাতে ধরিয়া গানের তালে তালে কোকে বেঁকে ঝপ, ঝপ শব্দে জল ঠেলিয়া দ্রুতবেগে চলিয়াছে। গানের কথাগুলি শুনিবার জন্ত কান পাতিলাম, অবশেষে বারম্বার আবৃত্তি শুনিয়া যে ধুয়াটি উদ্ধার করিলাম তাহা এই— যুবতী, ক্যান বা কর মন ভারী । পাবনা থ্যাহে আন্তে দেব ট্যাহা-দামের মোটরি ॥ ভরা বর্ষার জলপ্লাবনের উপর যখন নি:শব্দে স্বর্য অস্ত যাইতেছে এ গানটি ঠিক তখনকার উপযুক্ত কি না সে সম্বন্ধে পাঠকমাত্রেরষ্ট সন্দেহ হইতে পারে, কিন্তু গানের এই দুটি চরণে সেই শৈবালবিকীর্ণ জলমরুর মাঝখান হইতে সমস্ত গ্রামগুলি যেন কথা কহিয়া উঠিল । দেখিলাম, এই গোয়ালঘরের পাশে, এই কুলগাছের ছায়ায়, এখানে ও যুবতী মন-ভারী করিয়া থাকেন এবং তাহার রোষারুণ কুটিল কটাক্ষপাতে গ্রাম্য কবির কবিতা ছন্দে-বন্ধে স্বরে-তালে মাঠে-ঘাটে জলে-স্থলে জাগিয়া উঠিতে থাকে । জগতে যত প্রকার দুর্বিপাক আছে যুবতীচিত্তের বিমুখত তাহার মধ্যে অগ্রগণ্য ; সেই দুর্গ্রহ-শাস্তির জন্ত কবির ছন্দোরচনা এবং প্রিয়প্রসাদবঞ্চিত হতভাগ্যগণ প্রাণপাত পর্যস্ত করিতে প্রস্তুত । কিন্তু যখন গানের মধ্যে শুনিলাম ‘পাবনা থেকে আনি দিব টাকা-দামের মোটরি’, তখন ক্ষণকালের জন্য মনের মধ্যে বড়ো একটা আশ্বাস অনুভব করা গেল । মোটরি পদার্থটি কী তাহা ঠিক জানি না, কিন্তু তাহার মূল্য ষে এক টাকার বেশি নহে কবি তাহাতে সন্দেহ রাখেন নাই। জগতের এক প্রাস্তে পাবনা জিলায় যে এমন একটা স্থান আছে যেখানে প্রতিকূল প্রণয়িনীর জন্ত অসাধ্যসাধন করিতে হয় না, পাবনা অপেক্ষ দুর্গম স্থানে ষাইতে এবং ‘মোটরি’ অপেক্ষ দুর্লভ পদার্শ্ব সংগ্ৰছ করিতে হয় না, ইহা মনে করিলে ভাবষন্ত্রণ অপেক্ষাকৃত স্বসহ বলিয়া বোধ হয় । কালিদাস ভবভূতি প্রভৃতি প্রথম শ্রেণীর কবিরা এমন স্থলে নিশ্চয়ই মানসসরোবরের স্বর্ণপক্ষ, আকাশের তারা এবং নন্দনকাননের পারিজাত