পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\98\9 রবীন্দ্র-রচনাবলী মেঘদূত বিরহের কাব্য । বিরহাবস্থায় দৃঢ়বন্ধ দাম্পত্যস্থত্রে কিঞ্চিৎ ব্যবচ্ছেদ ঘটির মানব যেন পুনশ্চ স্বতন্ত্রভাবে ভালোবাসিবার অবসর লাভ করে। স্ত্রীপুরুষের মধ্যে সেই ব্যবধান যেখানে পড়ে হৃদয়ের প্রবল অভিমুখী গতি আপনাকে স্বাধীনভাবে প্রবাহিত করিতে স্থান পায় । কুমারসম্ভবে কুমারী গৌরী যদি প্রচলিত সমাজনিয়মের বিরুদ্ধে শৈলতপোবনে একাকিনী মহাদেবের সেবা না করিতেন, তবে তৃতীয় সর্গের ন্যায় অমন অতুলনীয় কাব্যের স্বষ্টি হইত কী করিয়া ? এক দিকে বসন্তপুপাভরণা শিরীষপেলবা বেপথুমতী উমা, অন্ত দিকে যোগাসীন মহাদেবের অগাধস্তম্ভিত সমুদ্রবিশাল হৃদয়, লোকালয়ের নিয়ম প্রাচীরের মধ্যে বিশ্ববিজয়ী প্রেমের এমন মহান স্বযোগ মিলিত কোথায় ? যাহা হউক, মানবরচিত সমাজ আপনার মধ্যে আপনি সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত নয়। যে শক্তি সমাজকে সমাজের বাহিরের দিকে টানে সেই সৌন্দর্য সেই প্রেমের শক্তিকে অন্তত মানসলোকে স্থাপন করিয়া কল্পনার দ্বারা উপভোগ না করিয়া মহিষ থাকিতে পারে না । পার্থিব সমাজে যদি বা বাধা পায় তবে দ্বিগুণ তীব্রতার সহিত আধ্যাত্মিক ভাবের মধ্যে তাহাকে আয়ত্ত করিতে চেষ্টা করে । বৈষ্ণবের গান যে দেখিতে দেখিতে সমস্ত ভারতবর্ষ ছাইয়া ফেলিয়াছে ইহাই তাহার প্রধান কারণ । বৈষ্ণবের গান স্বাধীনতার গান । তাহ জাতি মানে না, কুল মানে না । অথচ এই উচ্চুম্বলতা সৌন্দর্যবন্ধনে হৃদয়বন্ধনে নিয়মিত । তাহ অন্ধ ইভ্রিত্বের উদভ্ৰান্ত উন্মত্ততমাত্র নহে । হরগৌরীকথায় দাম্পত্যবন্ধনে যেমন কতকগুলি বাধা বর্ণিত হইয়াছে, বৈষ্ণব গাথার প্রেমপ্রবাহেও তেমনি একমাত্র প্রবল বাধার উল্লেখ আছে– তাহা সমাজ । তাহা একাই এক সহস্ৰ । বৈষ্ণব পদাবলীতে সেই সমাজবাধীর চতুর্দিকে প্রেমের তরঙ্গ উচ্ছসিত হইয়া উঠিতেছে । এমন-কি বৈষ্ণব কাব্যশাস্কে পরকীয়া অমুরক্তির বিশেষ গৌরব বর্ণিত হইয়াছে। সে গৌরব সমাজনীতির হিসাবে নহে সে কথা বলাই বাহুল্য । তাহা নিছক প্রেমের হিসাবে । ইহাতে যে আত্মবিশ্বতি, বিশ্ববিশ্বতি, নিন্দী-ভয়-লঙ্গ-শাসন সম্বন্ধে সম্পূৰ্ণ ঔদাসীন্ত, কঠিন কুলাচার-লোকাচারের প্রতি অচেতনতা প্রকাশ পায়, তদ্বারা প্রেমের প্রচণ্ড বল, দুর্বোধ রহস্ত, তাহার বন্ধনবিহীনতা, সমাজ-সংসার স্থান-কাল-পাত্র এবং যুক্তিতর্ক-কাৰ্যকারণের অতীত একটা বিরাট ভাব পরিস্ফুট হইয় উঠে । এই কারণে বাহা বিশ্বসমাজে সর্বত্রই একবাক্যে নিন্দিত সেই অভ্ৰভেদী কলঙ্কচূড়ার উপরে বৈষ্ণব কবিগণ র্তাহাজের বর্ণিত প্রেমকে স্থাপন করিয়া তাহার অভিষেকক্রিয়া সম্পন্ন করিয়াছেন । এই সর্বনাশী, সর্বত্যাগী।