পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

লোকসাহিত্য )۹ تمامی সর্ববন্ধনচ্ছেদী প্রেমকে আধ্যাত্মিক অর্থে গ্রহণ করিতে না পারিলে কাব্য হিসাবে ক্ষতি হয় নু, সমাজনীতি হিসাবে হইবার কথা । এইরূপ প্রেমগানের প্রচার সাধারণ লোকের পক্ষে বিপজ্জনক এবং সমাজের পক্ষে অহিতকর মনে হইতে পারে । কিন্তু ফলত তাহা সম্পূর্ণ সত্য নহে। মানবপ্রকৃতিকে সমাজ একেবারে উনমূলিত করিতে পারে না । তাহা কাজে কথায় কল্পনায় আপনাকে নানা প্রকারে ব্যক্ত করিয়া তোলে । তাহা এক দিক হইতে প্রতিহত হইয়া আরএক দিক দিয়া প্রবাহিত হয় । মানবপ্রকৃতিকে অযথাপরিমাণে এবং সম্পূর্ণভাবে রোধ করাতেই সমাজের বিপদ । সে অবস্থায় যখন সেই রুদ্ধ প্রকৃতি কোনো-একটা আকারে বাহির হইবার পথ পায় তখনই বরঞ্চ বিপদের কতকটা লাঘব হয় । আমাদের দেশে যখন বন্ধবিহীন প্রেমের সমাজবিহিত প্রকাশু স্থান কোথাও নাই, সদর দরজা যখন তাহার পক্ষে একেবারেষ্ট বন্ধ, অথচ তাহাকে শাস্ত্র চাপা দিয়া গোর দিলেও সে যখন ভূত হইয়া মধ্যাহ্নরণত্রে রুদ্ধ দ্বারের ছিদ্রমধ্য দিয়া দ্বিগুণতর বলে লোকালয়ে পর্যটন করিয়া বেড়ায়, তখন বিশেষরূপে আমাদের সমাজেই সেই কুলমান গ্রাসী কলস্ক-অঙ্কিত প্রেম স্বাভাবিক নিয়মে গুপ্তভাবে স্থান পাইতে বাধ্য— বৈষ্ণব কবিরা সেই বন্ধননাশী প্রেমের গভীর দুৰ্নিবার আবেগকে সৌন্দর্যক্ষেত্রে অধ্যাত্মলোকে বহুমান করিয়া তাহাকে অনেক পরিমাণে সংসারপথ হইতে মানসপথে বিক্ষিপ্ত করিয়া দিয়াছেন, আমাদের সমাজের সেই চিরক্ষুধাতুর প্রেতটাকে পবিত্র গয়ায় পি গুদান করিবার আয়োজন করিয়াছেন । তাহারা কামকে প্রেমে পরিণত করিবার জন্য ছন্দোবন্ধ কল্পনার বিবিধ পরশপাথর প্রয়োগ করিয়াছেন । তাহীদের রচনার মধ্যে যে ইন্দ্রিয়বিকার কোথাও স্থান পায় নাই তাহা বলিতে পারি না । কিক্ষ বৃহৎ শ্রোতস্বিনী নদীতে যেমন অসংখ্য দূষিত ও মৃত পদার্থ প্রতিনিয়ত আপনাকে আপনি সংশোধন করে তেমনি সৌন্দর্য এবং ভাবের বেগে সেই-সমস্ত বিকার সহজেই শোধিত হইয়া চলিয়াছে । বরঞ্চ বিদ্যাসুন্দরের কবি সমাজের বিরুদ্ধে যথার্থ অপরাধী । সমাজের প্রাসাদের নীচে তিনি হাসিয়া হাসিয়া স্বরঙ্গ খনন করিয়াছেন । সে সুরঙ্গমধ্যে পূত স্বর্যালোক এবং উন্মুক্ত বায়ুর প্রবেশপথ নাই। তথাপি এই বিদ্যাস্বন্দর কাব্যের এবং বিদ্যা সুন্দর যাত্রার এত আদর আমাদের দেশে কেন ? উহা অত্যাচারী কঠিন সমাজের প্রতি মানবপ্রকৃতির স্বনিপুণ পরিহাস । বৈষ্ণব কবি যে জিনিসটাকে ভাবের ছায়াপথে স্বন্দরক্সপে অঙ্কিত করিয়াছেন, ইনি সেইটাকে সমাজের পিঠের উপরে দাগার মতো জাপিয়া দিয়াছেন, যে দেখিতেছে সেই কৌতুক অনুভব করিতেছে । যাহা হউক, মোটের উপর, হরগৌরী এবং কৃষ্ণরাধাকে লইয়া আমাদের গ্রাম্য ©193