পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অচলায়তন V9)( আচার্য। ঠিক, ঠিক-ঠিক বলেছ। সুতসোম। অচেনার মধ্যে গিয়ে কোথায় তার অন্ত পাব ? এখানে সমস্তই জানা, সমস্তই অভ্যস্ত-এখানকার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এখানকারই সমস্ত শাস্ত্রের ভিতর থেকে পাওয়া যায়- তার জন্যে একটুও বাইরে যাবার দরকার হয় না। এই তো নিশ্চল শান্তি । গুরু, তুমি যখন আসবে, কিছু সরিয়ো না কিছু আঘাত কোরো না- চারি দিকেই আমাদের শান্তি, সেই বুঝে পা ফেলো । দয়া কোরো, দয়া কোরো আমাদের । আমাদের পা আড়ষ্ট হয়ে গেছে, আমাদের আর চলবার শক্তি নেই। অনেক বৎসর অনেক যুগ যে এমনি করেই কেটে গেল— প্রাচীন, প্রাচীন, সমস্ত প্রাচীন হয়ে গেছে— আজি হঠাৎ বোলো না যে নূতনকে চাই- আমাদের আর সময় নেই | উপাচার্য। আচার্যদেব, তোমাকে এমন বিচলিত হতে কখনাে দেখি নি। আচার্য। কী জানি, আমার কেমন মনে হচ্ছে কেবল একলা আমিই না, চারিদিকে সমস্তই বিচলিত হয়ে উঠেছে। আমার মনে হচ্ছে আমাদের এখানকার দেয়ালের প্রত্যেক পাথরটা পর্যন্ত বিচলিত । তুমি এটা অনুভব করতে পারিছ না। সূতসোম ? উপাচার্য। কিছুমাত্র না। এখানকার অটল স্তব্ধতার লেশমাত্র বিচূতি দেখতে পাচ্ছি নে। আমাদের তো বিচলিত হবার কথাও না । আমাদের সমস্ত শিক্ষা কোন কালে সমাধা হয়ে গেছে। আমাদের সমস্ত লাভ সমাপ্ত, সমস্ত সঞ্চয় পর্যাপ্ত । আচার্য। আজ আমার একটু একটু মনে পড়ছে বহুপূর্বে সব প্রথমে সেই ভোরের বেলা অন্ধকার । থাকতে থাকতে র্যার কাছে শিক্ষা আরম্ভ করেছিলুম তিনি গুরুই— তিনি পুঁথি নন, শাস্ত্ৰ নন, বৃত্তি নন, তিনি গুরু । তিনি যা ধরিয়ে দিলেন। তাই নিয়ে আরম্ভ করলুম— এতদিন মনে করে নিশ্চিন্ত ছিলুম সেইটেই বুঝি আছে, ঠিক চলছে— কিন্তু— উপাচার্য। ঠিক আছে, ঠিক চলছে আচাৰ্যদেব, ভয় নেই। প্ৰভু, আমাদের এখানে সেই প্রথম উষার বিশুদ্ধ অন্ধকারকে হাজার বছরেও নষ্ট হতে দিই নি । তারই পবিত্র অস্পষ্ট ছায়ার মধ্যে আমরা আচার্য এবং ছাত্র, প্ৰবীণ এবং নবীন, সকলেই স্থির হয়ে বসে আছি। তুমি কি বলতে চাও এতদিন পরে কেউ এসে সেই আমাদের ছায়া নাড়িয়ে দিয়ে যাবে ! সর্বনাশ ! সেই ছায়া ! ! আচাৰ্য । সর্বনাশই তো ! * উপাচাৰ্য । তা হলে হবে কী ! এতদিন যারা স্তব্ধ হয়ে আছে তাদের কি আবার উঠতে হবে ? আচাৰ্য । আমি তো তাই সামনে দেখছি । সে কি আমার স্বপ্ন ! অথচ আমার তো মনে হচ্ছে এই সমস্তই স্বপ্ন- এই পাথরের প্রাচীর, এই বন্ধ দরজা, এই সব নানা রেখার গণ্ডি, এই স্তৃপাকার । পুঁথি, এই অহােরাত্র মন্ত্রপাঠের গুঞ্জনধ্বনি- সমস্তই স্বপ্ন । উপাচার্য। ঐ-যে পঞ্চক আসছে। পাথরের মধ্যে কি ঘাস বেরোয় ! এমন ছেলে আমাদের আয়তনে কী করে সম্ভব হল ! শিশুকাল থেকেই ওর ভিতর এমন-একটা প্রবল অনিয়ম আছে, তাকে কিছুতেই দমন করা গেল না। ঐ বালককে আমার ভয় হয়। ঐ আমাদের দুর্লক্ষণ। এই আয়তনের মধ্যে ও কেবল তোমাকেই মানে । তুমি ওকে একটু ভৎসনা করে দিয়ো । আচার্য। আচ্ছা, তুমি যাও । আমি ওর সঙ্গে একটু নিভৃতে কথা কয়ে দেখি । উপাচার্যের প্রস্থান [ ܖ পঞ্চকের প্রবেশ আচাৰ্য । (পঞ্চকের গায়ে হাত দিয়া) বৎস পঞ্চক ! পঞ্চক । করলেন কী ! আমাকে ছুলেন ? আচার্য। কেন, বাধা কী আছে ? 、 পঞ্চক । আমি যে আচার রক্ষা করতে পারি নি । আচার্য। কেন পার নি। বৎস ?