পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দুই বোন শমিলা মেয়েরা দুই জাতের, কোনো কোনো পণ্ডিতের কাছে এমন কথা শুনেছি। এক জাত প্ৰধানত মা, আর-এক জাত প্ৰিয়া । ঋতুর সঙ্গে তুলনা করা যায় যদি, মা হলেন বৰ্ষাঋতু। জলদান করেন, ফলদান করেন, নিবারণ করেন তাপ, উর্ধর্বলোক থেকে আপনাকে দেন বিগলিত করে, দূর করেন। শুষ্কতা, ভরিয়ে দেন অভাব। আর প্রিয়া বসন্তঋতু। গভীর তার রহস্য, মধুর তার মায়ামন্ত্র, তার চাঞ্চল্য রক্তে তোলে তরঙ্গ, পৌঁছয় চিত্তের সেই মণিকোঠায়, যেখানে সোনার বীণায় একটি নিভৃত তার রয়েছে। নীরবে, ঝংকারের অপেক্ষায়, যে-ঝংকারে বেজে বেজে ওঠে সর্ব দেহে মনে অনির্বচনীয়ের বাণী । শশাঙ্কের স্ত্রী শর্মিলা মায়ের জাত । বড়ো বড়ো শান্ত চোখ ; ধীর গভীর চাহনি ; জলভরা নবমেঘের মতো নধর দেহ, স্নিগ্ধ শ্যামল ; সিঁথিতে সিঁদুরের অরুণরেখা ; শাড়ির কালো পাড়টি প্রশস্ত ; দুই হাতে মকরমুখো মোটা দুই বালা, সেই ভূষণের ভাষা প্রসাধনের ভাষা নয়, শুভসাধনের ভাষা । স্বামীর জীবনলোকে এমন কোনো প্ৰত্যন্তদেশ নেই। যেখানে তার সাম্রাজ্যের প্রভাব শিথিল । স্ত্রীর অতিলালনের আওতায় স্বামীর মন হয়ে পড়েছে অসাবধান। ফাউন্টেন কলমটা সামান্য দুর্যোগে, টেবিলের কোনাে অনতিলক্ষ্য অংশে ক্ষণকালের জন্যে অগােচর হলে সেটা পুনরাবিষ্কারেব ভার স্ত্রীর 'পরে। স্নানে যাবার পূর্বে হাতঘড়িটা কোথায় ফেলেছে। শশাঙ্কর হঠাৎ সেটা মনে পড়ে না, স্ত্রীর সেটা নিশ্চিত চােখে পড়ে। ভিন্ন রঙের দু-জোড়া মোজার এক-এক পাটি এক-এক পায়ে পরে বাইরে যাবার জন্যে যখন সে প্রস্তুত, স্ত্রী এসে তার প্রমাদ সংশোধন করে দেয়। বাংলা মাসের সঙ্গে ইংরেজি মাসের | তারিখ জোড়া দিয়ে বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করে, তার পরে অকালে অপ্রত্যাশিত অতিথিসমাগমের আকস্মিক দায় পড়ে স্ত্রীর উপর । শশাঙ্ক নিশ্চয় জানে দিনযাত্রায় কোথাও ত্রুটি ঘটলেই স্ত্রীর হাতে তার সংস্কার হবেই, তাই ত্রুটি ঘটানোই তার স্বভাব হয়ে পড়েছে। স্ত্রী সমেহ তিরস্কারে বলে, “আর তো পারি নে। সুমকি কিছুতেই শিক্ষা হবে না।” যদি শিক্ষা হত তবে শৰ্মিলার দিনগুলাে হত অনাবাদি ফসলের ANNO | শশাঙ্ক হয়তো বন্ধুমহলে নিমন্ত্রণে গেছে। রাত এগারোটা হল, দুপুর হল, ব্রিজ খেলা চলছে। হঠাৎ বন্ধুরা হেসে উঠল, “ওহে, তােমার সমনজারির পেয়াদা। সময় তােমার আসন্ন।” সেই চিরপরিচিত মহেশ চাকর । পাকা গোফ, কঁচা মাথার চুল, গায়ে মেরজাই পরা, কাধে রঙিন ঝাড়ন, বগলে বীশের লাঠি । মােঠাকরুন খবর নিতে পাঠিয়েছেন। বাবু কি আছেন। এখানে ? মােঠাকরুনের ভয়, পাছে ফেরবার পথে অন্ধকার রাতে দুর্যোগ ঘটে। সঙ্গে একটা লণ্ঠনও পাঠিয়েছেন। শশাঙ্ক বিরক্ত হয়ে তাস ফেলে দিয়ে উঠে পড়ে। বন্ধুরা বলে, “আহা, এক অরক্ষিত পুরুষমানুষ।” বাড়ি ফিরে এসে শশাঙ্ক স্ত্রীর সঙ্গে যে আলাপ করে সেটা না স্নিগ্ধ ভাষায় না শান্ত ভঙ্গিতে । শৰ্মিলা টুপ করে ভৎসনা মেনে নেয়। কী করবে, পারে না থাকতে। যতপ্রকার অসম্ভব বিপত্তি ওর অনুপস্থিতির অপেক্ষায় স্বামীর পথে ষড়যন্ত্র করে, এ আশঙ্কা ও কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারে না ।