পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ܓ8Q ছুটােছটা কাজ কোথা থেকে সে খুঁজে বের করে, আপিস-ঘরে গিয়ে প্ল্যান আঁকবার তেলা কাগজ কিংবা খাতপত্র নিয়ে বসে। তবু সাবেক কালের নিয়ম চলছে। মোটা গদিওআলা সোফার সামনে প্রস্তুত থাকে। পশমের চটিজোড়া । সেখানে পানের বাটায় আগেকার মতোই পান থাকে সাজা, আলনায় থাকে পাতলা সিস্কের পাঞ্জাবি, কেঁচানো ধুতি । আপিস-ঘরটাতে হস্তক্ষেপ করতে সাহসের দরকার, তবু শশাঙ্কের অনুপস্থিতি-কালে ঝাড়ন হাতে শৰ্মিলা সেখানে প্রবেশ করে । সেখানকার রক্ষণীয় এবং বর্জনীয় বস্তু-ব্যুহের মধ্যে সজ্জা ও শৃঙ্খলার সমন্বয়-সাধনে তার অধ্যবসায় অপ্রতিহত । শৰ্মিলা সেবা করছে, কিন্তু আজকাল সেই সেবার অনেকখানি অগোচরে । আগে তার যে আত্মনিবেদন ছিল প্ৰত্যক্ষের কাছে এখন তার প্রয়োগটা প্রতীকে- বাড়িঘর সাজানোয়, বাগান করায়, যে চৌকিতে শশাঙ্ক বসে তারই রেশমের ঢাকায়, বালিশের ওয়াড়ের ফুলকটা কাজে, আপিসের টেবিলের কোণে রজনীগন্ধার গুচ্ছে সজ্জিত নীল স্ফটিকের ফুলদানিতে । নিজের অর্ঘ্যকে পূজাবেদীর থেকে দূরে স্থাপন করতে হল, কিন্তু অনেক দুঃখে । এই অল্পদিন আগেই যে ঘা পেয়েছে তার চিহ্ন গোপনে চােখের জল ফেলে ফেলে মুছতে হয়েছে। সেদিন উনত্রিশে কাৰ্তিক, শশাঙ্কের জন্মদিন । শৰ্মিলার জীবনে সব চেয়ে বড়ো পরব । যথারীতি বন্ধুবান্ধবদের নিমন্ত্রণ করা হল, ঘরদুয়োর বিশেষ করে সাজানো হয়েছে ফুলে পাতায় । সকালের কাজ সেরে শশাঙ্ক বাড়ি ফিরে এসে বললে, “এ কী ব্যাপার । পুতুলের বিয়ে নাকি ৷” “হায় রে কপাল, আজ তোমার জন্মদিন, সে কথাটাও ভুলে গেছ ? যাই বল, বিকেলে কিন্তু তুমি বেরোতে পারবে না ।” “বিজনেস মৃত্যুদিন ছাড়া আর কোনো দিনের কাছে মাথা হেঁট করে না ।” “আর কখনো বলব না । আজ লোকজন নেমন্তান্ন করে ফেলেছি।” “দেখো শৰ্মিলা, তুমি আমাকে খেলনা বানিয়ে বিশ্বের লোক ডেকে খেলা করবার চেষ্টা কোরো না।” এই বলে শশাঙ্ক দ্রুত চলে গেল। শৰ্মিলা শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করে খানিকক্ষণ কঁদিলে। অপরাহুে লোকজন এল । বিজনেসের সর্বোচ্চ দাবি তারা সহজেই মেনে নিলে । এটা যদি হত বলে ধরে নিত । কিন্তু বিজনেস ! আমোদপ্রমোদ যথেষ্ট হল । নালুবাবু থিয়েটারের নকল করে সবাইকে খুব হাসালেন, শর্মিলাও সে হাসিতে যোগ দিলে। শশাঙ্ক-বিরহিত শশাঙ্কের জন্মদিন সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাত করলে শশাঙ্ক-অধিষ্ঠিত বিজনেসের কাছে। দুঃখ যথেষ্ট হল, তবু শৰ্মিলার মনও দূর থেকে প্ৰণিপাত করলে শশাঙ্কের এই ধাবমান কাজের রথের ধবজাটাকে । ওর কাছে সেই দুরধিগম্য কাজ, যা কারও খাতির করে না, স্ত্রীর মিনতিকে না, বন্ধুর নিমন্ত্রণকে না, নিজের আরামকে না । এই কাজের প্রতি শ্রদ্ধা দ্বারা পুরুষমানুষ নিজেকে শ্রদ্ধা করে, এ তার আপনি শক্তির কাছে আপনাকে নিবেদন । শৰ্মিলা ঘরকন্নার প্রাত্যহিক কর্মধারার পারে দাড়িয়ে সসন্ত্রমে চেয়ে দেখে তার পরপারে শশাঙ্কের কাজ । বহুব্যাপক তার সত্তা, ঘরের সীমানা ছাড়িয়ে চলে যায় সে দূরদেশে, দূর সমুদ্রের পারে, জানা-অজানা কত লোককে টেনে নিয়ে আসে আপন শাসনজালে। নিজের অদৃষ্টের সঙ্গে পুরুষের প্রতিদিনের সংগ্রাম ; তারই বন্ধুর যাত্রাপথে মেয়েদের কোমল বাহু-বন্ধন যদি বাধা ঘটাতে আসে। তবে পুরুষ তাকে নির্মম বেগে ছিন্ন করে যাবে বৈকি । এই নির্মমতাকে শৰ্মিলা ভক্তির সঙ্গেই মেনে নিলে। মাঝে মাঝে থাকতে পারে না, যেখানে অধিকার নেই হৃদয়ের টানে সেখানেও নিয়ে আসে তার সকরুণ উৎকণ্ঠা, আঘাত পায়, সে আঘাতকে প্ৰাপ্য গণ্য করেই ব্যথিতমানে পথ ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসে। দেবতাকে বলে “দৃষ্টি রেখো, যেখানে তার নিজের গতিবিধি অবরুদ্ধ । p