পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

888 রবীন্দ্র-রচনাবলী দেওয়া এবং কাজে নিজের মতে চলা । এই স্বামী-পালনের দায় এত দিন আনন্দে বহন করে এসেছে *†ळ्लिा । এত কাল তো কাটল । নিজেকে বিবর্জিত করে শশাঙ্কের জগৎকে শর্মিলা কল্পনাই করতে পারে না। আজ ভয় হচ্ছে মৃত্যুর দূত এসে জগৎ আর জগদ্ধাত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটায় বুঝি বা । এমন-কি, ওর আশঙ্কা যে, মৃত্যুর পরেও শশাঙ্কের দৈহিক অযত্ন শর্মিলার বিদেহী আত্মাকে শান্তিহীন করে রাখবে। ভাগ্যে উমি ছিল। সে ওর মতো শান্ত নয়। তবু ওর হয়ে কাজকর্ম চালিয়ে নিচ্ছে। সে । কাজও তো মেয়েদের হাতের কাজ । ঐ স্নিগ্ধ হাতের স্পর্শ না থাকলে পুরুষদের প্রতিদিনের জীবনের প্রয়োজনে রস থাকে না যে, সমস্তই যে কিরকম শ্ৰীহীন হয়ে যায়। তাই উমি যখন তার সুন্দর হাতে ছুরি নিয়ে আপেলের খোসা ছাড়িয়ে কেটে কেটে রাখে, কমললেবুর কোয়াগুলিকে গুছিয়ে রাখে সাদা পাথরের থালার এক পাশে, বেদানা ভেঙে তার দানাগুলিকে যত্ন করে সাজিয়ে দেয়, তখন শর্মিলা তার বোনের মধ্যে যেন নিজেকেই উপলব্ধি করে । বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাকে সর্বদাই কাজের ফরমাশ করছে । ওর সিগারেট-কেসটা ভরে দে-না, উমি । । দেখছিস নে ময়লা রুমালটা বদলাবার খেয়াল নেই ? ঐ দেখ, জুতোটা সিমেন্টে বালিতে জমে নিরেট হয়ে রয়েছে। বেহারাকে সাফ করতে হুকুম করবে: তার হঁশ নেই । বালিশের ওয়াড়গুলো বদলে দে-না, ভাই । ফেলে দে ঐ ছেড়া কাগজগুলো বুড়ির মধ্যে । একবার আপিস-ঘরটা দেখে আসিস তো উমি, আমি নিশ্চয় বলছি ওঁর ক্যাশবাক্সের চাবিটা ডেস্কের উপর ফেলে রেখে বেরিয়ে গেছেন । ফুলকোপির চারাগুলি তুলে পোতবার সময় হল, মনে থাকে যেন । মালীকে বলিস গোলাপের ডালগুলো ছেটে দিতে । ঐ দেখা কোটের পিঠেতে চুন লেগেছে— এত তাড়া কিসের, একটু দাড়াও-না— উর্মি, দে তো বোন, বুরুশ করে । উমি বই-পড়া মেয়ে, কাজ-করা মেয়ে নয়, তবু ভারি মজা লাগছে। যে কড়া নিয়মের মধ্যে সে ছিল তার থেকে বেরিয়ে এসে কাজকর্ম সমস্তই ওর কাছে অনিয়মের মতোই ঠেকছে। এই সংসারের কর্মধারার ভিতরে ভিতরে যে উদবেগ আছে, সাধনা আছে, সে তো ওর মনে নেই— সেই চিন্তার সূত্রটি আছে। ওর দিদির মধ্যে। তাই ওর কাছে এই কাজগুলো খেলা, একরকম ছুটি, উদ্দেশ্যবিবর্জিত উদযোগ। ও যেখানে এত দিন ছিল এ তার থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জগৎ । এখানে ওর সম্মুখে কোনো লক্ষ্য তর্জনী তুলে নেই ; অথচ দিনগুলো কাজ দিয়ে পূর্ণ, সে কাজ বিচিত্র। ভুল হয়, ত্রুটি হয়, তার জন্যে কঠিন জবাবদিহি নেই। যদি বা দিদি একটু তিরস্কার করতে চেষ্টা করে শশাঙ্ক হেসে উড়িয়ে দেয় ; যেন উর্মির ভুলটাতেই বিশেষ একটা রস আছে। বস্তুত আজকাল ওদের ঘরকন্নাতে দায়িত্বের গান্তীৰ্য চলে গেছে ; ভুলচুকে কিছু আসে যায় না। এমন একটা আলগা অবস্থা ঘটেছে। এইটেই শশাঙ্কের কাছে ভারি আরামের ও কৌতুকের । মনে হচ্ছে যেন পিকনিক চলছে। আর, উর্মি যে কিছুতেই চিন্তিত নয়, দুঃখিত নয়, লজ্জিত নয়, সব-তাতেই উচ্ছসিত, এতে শশাঙ্কের নিজের মন থেকে তার গুরুভার কর্মের পীড়নকে লঘু করে দেয়। কাজ শেষ হলেই, এমন-কি, না হলেও বাড়িতে ফিরে আসবার জন্যে। ওর মন উৎসুক হয়ে ওঠে । এ কথা মানতেই হবে উমি কাজে পটু নয়। তবু একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখা গেল, কাজ দিয়ে না হােক, নিজেকে দিয়েই এ বাড়ির অনেক দিনের মস্ত একটা অভাব পূরণ করেছে— সেই অভাবটা ঠিক যে কী তা নির্দিষ্ট ভাষায় বলা যায় না। তাই, শশাঙ্ক যখন বাড়িতে আসে তখন সেখানকার হাওয়ায় খেলানো একটা ছুটির হিল্লোল অনুভব করে। সেই ছুটি কেবল ঘরের সেবায় নয়, কেবল