পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দুই বোন 8GS ধ্ৰুক পড়ল, ক্লান্তির কথা মনে করে শর্মিলা ওকে ক্ষমা করেছে। কিসের অনুতাপে উর্মি আজ অবসয় । কেন মনে হচ্ছে, ওর হার হতে চলল। দিদিকে গিয়ে বললে, “দিদি, আমি তো তোমার কোনো কাজ করতেই পারি নে— বল তো বাড়ি ফিরে যাই!” আজ তো শৰ্মিলা বলতে পারলে না 'না, যাস নে । বললে, “আচ্ছ, যা তুই। তাের পড়াশুনাের ক্ষতি হচ্ছে। যখন মাঝে মাঝে সময় পাবি দেখে-শুনে যাস ।” শশাঙ্ক তখন কাজে বেরিয়ে গেছে। সেই অবকাশে সেই দিনই উমি বাড়ি চলে গেল । শশাঙ্ক সেদিন যান্ত্রিক ছবি আঁকার এক-সেট সরঞ্জাম কিনে বাড়ি ফিরলে। উর্মিকে দেবে, কথা ছিল তাকে এই বিদ্যেটা শেখাবে। ফিরে এসে তাকে যথাস্থানে না দেখতে পেয়ে শৰ্মিলার ঘরে এসে জিজ্ঞাসা করল, “উমি গেল কোথায় ।” শৰ্মিলা বললে, “এখানে তার পড়াশুনোর অসুবিধে হচ্ছে বলে সে বাড়ি চলে গেছে।” “কিছু দিন অসুবিধে করবে বলে সে তো প্ৰস্তুত হয়েই এসেছিল। অসুবিধের কথা হঠাৎ আজই মনে উঠল। কেন ।” কথার সুর শুনে শর্মিলা বুঝলে শশাঙ্ক তাকেই সন্দেহ করছে। সে সম্বন্ধে কোনো বৃথা তর্ক না করে বললে, “আমার নাম করে তুমি তাকে ডেকে নিয়ে এসো, নিশ্চয় কোনো আপত্তি করবে না ।” উর্মি বাড়িতে ফিরে এসে দেখলে, অনেক দিন পরে বিলেত থেকে ওর নামে নীরদের চিঠি এসে অপেক্ষা করছে। ভয়ে খুলতেই পারছিল না । মনে জানে, নিজের তরফে অপরাধ জমা হয়ে উঠেছে। নিয়মভঙ্গের কৈফিয়ত-স্বরূপ এর আগে দিদির রোগের উল্লেখ করেছিল। কিছুদিন থেকে কৈফিয়তটা প্রায় এসেছে মিথ্যে হয়ে । শশাঙ্ক বিশেষ জেদ করে শর্মিলার জন্যে দিনে একজন রাত্রে একজন নার্স নিযুক্ত করে দিয়েছে। ডাক্তারের বিধান-মতে রোগীর ঘরে সর্বদা আত্মীয়দের আনাগোনা তারা রোধ করে । উমি মনে জানে নীরদ দিদির রোগের কৈফিয়তটাকেও গুরুতর মনে করবে না ; বলবে, ওটা কোনো কাজের কথা নয়।” বস্তুতই কাজের কথা নয়- “আমাকে তো দরকার হচ্ছে না” । অনুতপ্তচিত্তে স্থির করলে, ‘এবারে দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইব । বলব, আর কখনো ত্রুটি হবে না, কিছুতে নিয়মভঙ্গ করব না ।” চিঠি খোলবার আগে অনেক দিন পরে আবার বের করলে সেই ফোটোগ্রাফখানা । টেবিলের উপর রেখে দিলে। জানে ঐ ছবিটা দেখলে শশাঙ্ক খুব বিদ্রুপ করবে। তবু উর্মি কিছুতেই কুষ্ঠিত হবে না। তার বিদ্রুপে ; এই তার প্রায়শ্চিত্ত । নীরদের সঙ্গে ওর বিবাহ হবে এই প্রসঙ্গটা দিদিদের বাড়িতে ও চাপা দিত। অন্যেরাও তুলত না ; কেননা এ প্রসঙ্গটা ওখানকার সকলের অপ্রিয়। আজ হাত মুঠো করে উর্মি স্থির করলে- ওর সকল ব্যবহারেই এই সংবাদটা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করবে। কিছুদিন থেকে লুকিয়ে রেখেছিল এনগেজমেন্ট আংটি। সেটা বের করে পরলে। আংটিটা নিতান্তই কম দামের— নীরদ আপন অনেস্ট গরিবিয়ানার গর্বের দ্বারাই ঐ সস্তা আংটির দাম হীরের চেয়ে বেশি বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভাবখানা এই যে, “আংটির দামেই আমার দাম নয়, আমার দামেই আংটির দাম।” নিজেকে যথাসাধ্য শোধন করে নিয়ে উর্মি অতি ধীরে লেফাফাটা খুললে। । চিঠিখানা পড়ে হঠাৎ লাফিয়ে উঠল। ইচ্ছা করল নাচতে, কিন্তু নাচ ওর অভ্যাস নেই। সেতারটা ছিল বিছানার উপর, সেটা তুলে নিয়ে সুর না বেঁধেই ঝনঝন ঝংকার দিয়ে যা-তা বাজাতে লাগল। * এমন সময়ে শশাঙ্ক ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলে "ব্যাপারখানা কি। বিলের দিন স্থির হয়ে গেল p" "ই শশাঙ্কদা, স্থির হয়ে গেছে।” "কিছুতেই নড়াচড় হবে না ?” “কিছুতেই না ।” ' . "তা হলে এইবেলা সানাই বায়না দিই, আর ভীমনাগের সন্দেশ ?” । "তোমাকে কোনো চেষ্টা করতে হবে না ।”