পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মালঞ্চ w 8wd কাজ করা একটা টােকা মাথায় সরলা বাগানের মালীদের খাটিয়ে বেড়াচ্ছে তখন নিজের অকৰ্মণ্য হাত-পাগুলোকে সহ্য করতে পারত না । অথচ সুস্থ অবস্থায় এই সরলাকেই প্রত্যেক ঋতুতে নিমন্ত্রণ করে পাঠিয়েছে নতুন চারা রোপণের উৎসবে । ভোরবেলা থেকে কাজ চলত। তার পরে ঝিলে সাতার কেটে স্নান, তার পরে গাছের তলায় কলাপাতায় খাওয়া, একটা গ্রামোফোনে বাজত দিশি-বিদিশি সংগীত । মালীদের জুটত দই চিড়ে সন্দেশ। তেঁতুলতলা থেকে তাদের কলরব শোনা যেত। ক্রমে বেলা আসত নেমে, ঝিলের জল উঠত। অপরাহুের বাতাসে শিউরিয়ে, পাখি ডাকত বকুলের ডালে, আনন্দময় ক্লাস্তিতে হত দিনের অবসান । ওর মনের মধ্যে যে রস ছিল নিছক মিষ্ট, আজ কেন সে হয়ে গেল কটু ; যেমন আজকালকার দুর্বল শরীরটা ওর অপরিচিত, তেমনি এখনকার তীব্র নীরস স্বভাবটাও ওর চেনা স্বভাব নয়। সে স্বভাবে কোনাে দাক্ষিণ্য নেই। এক-একবার এই দারিদ্র্য ওর কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, লজ্জা জাগে মনে, তবু কোনােমতে সামলাতে পারে না। ভয় হয়, আদিত্যের কাছে এই হীনতা ধরা পড়ছে বুঝি, কোনদিন হয়তো সে প্রত্যক্ষ দেখবে নীরজার আজকালকার মনখানা বাদুড়ের চঞ্চক্ষত ফলের মতো, ভদ্ৰ-প্ৰয়োজনের অযোগ্য । বাজল দুপুরের ঘণ্টা। মালীরা গেল চলে। সমস্ত বাগানটা নির্জন। নীরজা দূরের দিকে তাকিয়ে প্রধান দুশের ফটিকাও আভাস কেরন। যেখানে ছায়াহীন রৌদ্রে শূন্যতার পরে শূন্যতার ܔ নীরজা ডাকল, “রোশনি !” আয় এল। ঘরে । প্রৌঢ়া, কঁচা-পাকা চুল, শক্ত হাতে মোটা পিতলের কঙ্কণ, ঘাঘরার উপরে ওড়না । মাংসবিরল দেহের ভঙ্গিতে ও শুষ্ক মুখের ভাবে একটা চিরস্থায়ী কঠিনতা । যেন ওর আদালতে এদের সংসারের প্রতিকুলে ও রায় দিতে বসেছে। মানুষ করেছে নীরজাকে, সমস্ত দরদ তার পরেই। তার কাছাকাছি যারা যায় আসে, এমনকি, নীরজার স্বামী পর্যন্ত, তাদের সকলেরই সম্বন্ধে ওর একটা সতর্ক বিরুদ্ধতা । ঘরে এসে জিজ্ঞাসা করলে, “জাল এনে দেব খোখী ?” “না, বোস।” মেঝেরু-উপর হাঁটু উচু করে বসল আয়া। নীরজার দরকার কথা কওয়া, তাই আয়াকে চাই । আয় ওর স্বাগত উক্তির বাহন । নীরজা বললে, “আজ ভোরবেলায় দরজা খোলার শব্দ শুনলুম।” আয় কিছু বললে না ; কিন্তু তার বিরক্ত মুখভাবের অর্থ এই যে, “কবে না শোনা যায়।” নীরজা অনাবশ্যক প্রশ্ন করল, “সরলাকে নিয়ে বুঝি বাগানে গিয়েছিলেন ?” সুনিশ্চিত জানা আৰু রোজই এই প্রশ্ন। একবার হাত উলটয় মুখ ধর্কয়ে আয় চুপ করে বসে রইল । নীরজা বাইরের দিকে চেয়ে আপন মনে বলতে লাগল, “আমাকেও ভোরে জাগাতেন, আমিও যৌতুম বাগানের কাজে, ঠিক ঐ সময়েই। সে তো বেশিদিনের কথা নয়।” এই আলোচনায় যোগ দেওয়া কেউ তার কাছে। আশা করে না, তবু আয়া থাকতে পারলে না । বললে, “ওঁকে না নিলে বাগান বুঝি যেত শুকিয়ে ?” নীরজা আপন মনে বলে চলল, “নিয়ু মার্কেটে ভোরবেলাকার ফুলের চালান না পাঠিয়ে আমার একদিনও কাটত না । সেইরকম ফুলের চালান আজও গিয়েছিল, গাড়ির শব্দ শুনেছি। আজকাল চালান কে দেখে দেয় রোশনি ।” এই জানা কথার কোনো উত্তর করল না আয়া, ঠোঁট চেপে রইল বসে। VOO