পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8tro রবীন্দ্র-রচনাবলী সব কথা গোড়া থেকে বলতে ইচ্ছে করছে।” “সমস্ত আবার নূতন লাগছে আমার ” । “তার পরে জান হঠাৎ সবই ডুবল । যখন ডাঙায় টেনে তুলল বন্যা থেকে, তখন আর-একবার আদিতদার পাশে এসে ঠেকল আমার ভাগ্য। মিললুম তেমনি করেই- আমরা দুই ভাই, আমরা দুই বন্ধু। তার পর থেকে আদিতদার আশ্রয়ে আছি। এও যেমন সত্যি, তাকে আশ্রয় দিয়েছি সেও তেমনি সত্যি । পরিমাণে আমার দিক থেকে কিছু কম হয় নি এ আমি জোর করে বলব। তাই আমার পক্ষে একটুও কারণ ঘটে নি। সংকোচ করবার। এর আগে একত্রে ছিলেম যখন, তখন আমাদের যে-বয়স ছিল সেই বয়সটা নিয়েই যেন ফিরলুম, সেই সম্বন্ধ নিয়ে। এমনি করেই চিরদিন চলে যেতে পারত। আর বলে কী হবে ।” “কথাটা শেষ করে ফেলো ।” “হঠাৎ আমাকে ধাক্কা মেরে কেন জানিয়ে দিলে যে আমার বয়স হয়েছে। যেদিনকার আড়ালে একসঙ্গে কাজ করেছি। সেদিনকার আবরণ উড়ে গেছে এক মুহুর্তে | তুমি নিশ্চয় সব জােন রমেনদা, আমার কিছুই ঢাকা থাকে না তোমার চােখে । আমার উপরে বউদির রাগ দেখে প্রথম প্রথম ভারি আশ্চর্য লেগেছিল, কিছুতেই বুঝতে পারি নি। এতদিন দৃষ্টি পড়ে নি নিজের উপর, বউদিদির বিরাগের আগুনের আভায় দেখতে পেলেম নিজেকে, ধরা পড়লুম নিজের কাছে । আমার কথা বুঝতে পারছি कि ।” “তোমার ছেলেবেলাকার তলিয়ে-থাকা ভালোবাসা নাড়া খেয়ে ভেসে উঠছে উপরের তলায় ।” “আমি কী করব বলো। নিজের কাছ থেকে নিজে পালাই কী করে।” বলতে বলতে রমেনের হাত চেপে ধরলে । রমেন চুপ করে রইল। আবার সে বললে, “যতক্ষণ এখানে আছি ততক্ষণ বেড়ে চলেছে আমার অন্যায় ।” “অন্যায়। কার উপরে ।” “বউদির উপরে ।” “দেখো সরলা, আমি মানি নে ও সব পুঁথির কথা । দাবির হিসেব বিচার করবে। কোন সত্য দিয়ে । তোমাদের মিলন কতকালের ; তখন কোথায় ছিল বাউদি ।” “কী বলছি। রমেনদা ! আপনি ইচ্ছের দোহাই দিয়ে এ কী আবদারের কথা । আদিতদার কথাও তো ভাবতে হবে ।” । “হবে বৈকি। তুমি কি ভাবিছ, যে-আঘাতে চমকিয়ে দিয়েছে তোমাকে, সেই আঘাতটাই তাকে লাগে নি ।” F “রমেন নাকি ” পিছন থেকে শোনা গেল । “হাঁ দাদা ।” রমেন উঠে পড়ল। “তোমার বউদি তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, আয়া এসে এইমাত্র জানিয়ে গেল।” রমেন চলে গেল, সরলাও তখনই উঠে যাবার উপক্রম করলে 1 । আদিত্য বললে, “যেয়ো না সরি, একটু বোসো ।” আদিত্যের মুখ দেখে সরলার বুক ফেটে যেতে চায়। ঐ অবিশ্রাম কর্মরত আপনা-ভোলা মন্ত মানুষটা এতক্ষণ যেন কেবলই পাক খেয়ে বেড়াচ্ছিল হালভাঙা ঢেউখাওয়া নীেকার মতো । আদিত্য বললে, “আমরা দুজনে এ সংসারে জীবন আরম্ভ করেছিলেম একেবারে এক হয়ে । এত সহজ। আমাদের মিল যে এর মধ্যে কোনো ভেদ কোনো কারণে ঘটতে পারে সে কথা মনে করাই অসম্ভব। তাই কি নয় সরি।” “অন্ধুরে যা এক থাকে, বেড়ে উঠে তা ভাগ হয়ে যায়। এ কথা না মেনে তো থাকবার জো নেই আদিতদা ।” -