পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8०२ রবীন্দ্র-রচনাবলী ম্যাপে পেনসিলের দাগ দিয়ে সমস্ত ব্যবস্থা করে দেব।” “আমার তাতে কোনো হাত থাকবে না ?” .ח. “না। যাবার আগে এ বাগানে সম্পূর্ণ আমারই ছাপ মেরে দেব । বলে রাখছি রাস্তার ধারের ঐ বাঁটুল-পামগুলো আমি একটাও রাখব না। ওখানে ঝাউগাছের সার লাগিয়ে দেব। অমন করে মাথা নেড়ো না। হয়ে গেলে তখন দেখো । তোমাদের ঐ লনটা আমি রাখব না, ওখানে মারবেলের একটা বেদী বাধিয়ে দেব ।” “বেদীটা কি ও জায়গায় মানাবে। একটু যেন— যাকে বলে সস্তা নবাবি ।” “চুপ করে । খুব মানাবে । তুমি কোনো কথা বলতে পারবে না । কিছুদিনের জন্যে এ বাগানটা হবে একলা আমার, সম্পূৰ্ণ আমার । তার পরে সেই আমার বাগানটা আমি তোমাকে দিয়ে যাব। ভেবেছিলে আমার শক্তি গেছে। দেখিয়ে দেব কী করতে পারি। আরো তিনজন মালী আমার চাই, আর মজুর লাগবে জন ছায়েক । মনে আছে একদিন তুমি বলেছিলে, বাগান সাজিয়ে তোলার শিক্ষা আমার হয় নি। হয়েছে কি না তার পরীক্ষা দিয়ে যাব । তোমাকে মনে রাখতেই হবে যে এ আমার বাগান, আমারই বাগান, আমার স্বত্ব কিছুতে যাবে না।” “আচ্ছা সেই ভালো, তা হলে আমি কী করব ।” “তুমি তোমার দোকান নিয়ে থাকো ; সেখানে তোমার আপিসের কাজ তো কম নয়।” “তোমাকে নিয়ে থাকাও তা হলে নিষিদ্ধ ?” । “হা, সর্বদা কাছে থাকবার মতো সে আমি আর নেই, এখন আমি কেবল আর-একজনকে মনে করিয়েই দিতে পারি, তাতে লাভ কী ।” “আচ্ছা বেশ । যখন তুমি আমাকে সহ্য করতে পারবে তখনই আসব | ডেকে পাঠিয়ো আমাকে । আজ সাজিতে তোমার জন্যে গন্ধরাজ এনেছি, রেখে যাই তোমার বিছানায়, কিছু মনে কোরো না ।” ব’লে আদিত্য উঠে পড়ল । নীরজা হাত ধরে বললে, “না, যেয়ো না, একটু বোসো ।” ফুলদানিতে একটা ফুল দেখিয়ে বললে, “জান এ ফুলের নাম ?” আদিত্য জানে কী জবাব দিলে ও খুশি হবে, তাই মিথ্যে করে বললে, “না, জানি নে ৷” “আমি জানি। বলব ? পেটুনিয়া । তুমি মনে কর আমি কিছু জানি নে, মুখুঁ আমি !" আদিত্য হেসে বললে, “সহধর্মিণী তুমি, যদি মুর্থ হও অন্তত আমার সমান মুর্থ। আমাদের জীবনে মুখতার কারবার আধাআধি ভাগে চলছে।” “সে কারবার আমার ভাগ্যে এইবারে শেষ হয়ে এল । ঐ-যে দারোয়ানটা ঐখানে বসে তামাক কুটছে, ও থাকবে দেউড়িতে, কিছুদিন পরেই আমি থাকব না। ঐ-যে গোরুর গাড়িটা পাথুরে কয়লা আজাড় করে দিয়ে খালি ফিরে যাচ্ছে ওর যাতায়াত চলবে রোজ রোজ, কিন্তু চলবে না। আমার এই হৃদয়যন্ত্রটা ।” আদিত্যের হাত হঠাৎ জোর করে চেপে ধরলে, বললে, “একেবারেই থাকিব না, কিছুই থাকব না ? বলে আমাকে, তুমি তো অনেক বই পড়েছি, বলো-না। আমাকে সত্যি করে ।” “যাদের বই পড়েছি তাদের বিদ্যে যতদূর আমারও ততদূর ! যমের দরজার কাছটাতে এসে থেমেছি, আর এগোই নি ।” । “বলো-না, তুমি কী মনে কর । একটুও থাকব না ? এতটুকুও না ?” “এখন আছি। এটাই যদি সম্ভব হয়, তখন থাকব। সেও সম্ভব ।” “নিশ্চয়ই সম্ভব, ঐ বাগানটা সম্ভব। আর আমিই হব। অসম্ভব, এ হতেই পারে না, কিছুতেই না । সন্ধেবেলায় আমনি করেই অস্পষ্ট আলোয় কাকেরা ফিরবে বাসায়, এমনি করেই দুলবে সুপুরিগাছের ডাল ঠিক আমারই চােখের সামনে। সেদিন তুমি মনে রেখো আমি আছি, আমি আছি, সমস্ত । বাগানময় আমি আছি। মনে কোরো বাতাস যখন তোমার চুল ওড়াচ্ছে আমার আঙুলের ছোয়া আছে তাতে । বিলো, মনে করবে ?”