পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমাজ । করা অসম্ভব হয় না এবং তাহার প্রায়শ্চিত্ত্বও যত্নসাধ্য বলিয়া মনে হয়। কিন্তু অতিসূক্ষ্ম যুক্তি বলে, যদি মানুষের স্বাধীন বুদ্ধির প্রতি কিঞ্চিম্মাত্র নির্ভর করা যায়। তবে দৈবা কাকদন্তির হিসাব না মিলিতে পারে। কারণ, মানুষ ঠেকিয়া শেখে- কিন্তু তিলমাত্র ঠেকিলেই যখন পাপ, তখন তাহাকে শিখিতে অবসর না দিয়া নাকে দড়ি দিয়া চালানোই যুক্তিসংগত। ছেলেকে ইটিতে শিখাইতে গেলে পড়তে দিতে হয়, তাহা অপেক্ষা তাহাকে বুড়াবয়স পর্যন্ত কোলে করিয়া লইয়া বেড়ানোই ভালো। তাহা হইলে তাহার পড়া হইল না, অথচ গতিবিধিও বন্ধ হইল না । ধূলির লেশমাত্র লাগিলে হিন্দুর দেবতার নিকট হিসাব দিতে হইবে, অতএব মনুষ্যজীবনকে তেলের মধ্যে ফেলিয়া শিশির মধ্যে নীতি-মিউজিয়ামের প্রদর্শনদ্রব্যের স্বরূপ রাখিয়া দেওয়াই সুপরামর্শ । ইহাকেই বলে কড়ায় কড়া, কাহনে কানা । কী রাখিলাম আর কী হারাইলাম সে কেহ বিচার করিয়া দেখে না । কবিকঙ্কণে বাণিজ্যবিনিময়ে আছে শুকুতার বদলে মুকুতা দিবে। ভেড়ার বদলে ঘোড়া । আমরা পণ্ডিতেরা মিলিয়া অনেক যুক্তি করিয়া শুক্তার বদলে মুক্ত দিতে প্ৰস্তুত হইয়াছি। মানসিক যে-স্বাধীনতা না থাকিলে পাপপুণ্যের কোনো অর্থই থাকে না, সেই স্বাধীনতাকে বলি দিয়া নামমাত্র পুণ্যকে তহবিলে জমা করিয়াছি। পাপপুণ্য-উত্থানপতনের মধ্য দিয়া আমাদের মনুষ্যত্ব উত্তরোত্তর পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে থাকে। স্বাধীনভাবে আমরা যাহা লাভ করি সে-ই আমাদের যথার্থ লাভ ; অবিচারে অন্যের নিকট হইতে যাহা গ্ৰহণ করি তাহা আমরা পাই না। ধূলিকদমের উপর দিয়া, আঘাতসংঘাতের মধ্য দিয়া, পতনপরাভব অতিক্রম করিয়া অগ্রসর হইতে হইতে যে-বল সঞ্চয় করি, সেই বলই আমাদের চিরজীবনের সঙ্গী । মাটিতে পদার্পণমাত্র না করিয়া, দুগ্ধফেনশুভ্ৰ পুণ্যশয্যায় শয়ান থাকিয়া হিন্দুর দেবতার নিকটে জীবনের একটি অতিনিষ্কলঙ্ক হিসাব প্ৰস্তুত করিয়া দেওয়া যায়- কিন্তু সে-হিসাব কী । একটি শূন্য শুভ্র খাতা । তাহাতে কলঙ্ক নাই এবং অঙ্কপাত নাই। পাছে কড়াক্ৰান্তি-কাকদন্তির গোল হয় এইজন্য আয় ব্যয় স্থিতিমাত্র নাই । 缸 নিখুঁত সম্পূর্ণতা মনুষ্যের জন্য নহে। কারণ, সম্পূর্ণতার মধ্যে একটা সমাপ্তি আছে। মানুষ ইহজীবনের মধ্যেই সমাপ্ত নহে। যাহারা পরলোক মানেন না, তাহারও স্বীকার করবেন, একটি জীবনের মধ্যেই মানুষের উন্নতিসম্ভাবনার শেষ নাই। নিম্নশ্রেণীর জন্তুরা ভূমিষ্ঠকাল অবধি মানবশিশুর অপেক্ষা অধিকতর পরিণত । মানবশিশু একান্ত অসহায় । ছাগশিশুকে চলিবার আগে পড়িতে হয় না। যদি বিধাতার নিকট চলার হিসাব দিতে হয়, ভুগোশবিক কাকত্তির হিসাব পর্যন্ত মিলাইয়া দিতে পারে। কিন্তু মানুষের পতন কে গণনা r জন্তুদের জীবনের পরিসর সংকীর্ণ, তাহারা অল্পদুর গিয়াই উন্নতি শেষ করে- এইজন্য আরম্ভকাল হইতেই তাহারা শক্তসমর্থ। মানুষের জীবনের পরিধি বহুবিত্তীর্ণ এইজন্য বহুকাল পর্যন্ত সে অপরিণত জন্তুরা যে-স্বাভাবিক নৈপুণ্য লইয়া জন্মগ্রহণ করে ইংরেজিতে তাহাকে বলে ইনসটিংকটু, বাংলায় । তাহার নাম দেওয়া যাইতে পারে সহজ-সংস্কার। সহজ-সংস্কার, অশিক্ষিতাপটুত্ব একেবারেই ঠিক পথ দিয়া চলিতে পারে, কিন্তু বুদ্ধি ইতস্তত করিতে করিতে ভ্রমের মধ্য দিয়া আপনার পথ সন্ধান করিয়া বাহির করে। সহজ-সংস্কার পশুদের, বুদ্ধি মানুষের। সহজ-সংস্কারের গম্যস্থান সামান্য সীমার মধ্যে, বুদ্ধির শেষ লক্ষ্য এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই। li আবশ্যকের আকর্ষণ চতুষ্পার্শ্ব বাচাইয়া, পথঘাট দৈখিয়া, ক্ষেত্র নিষ্কণ্টক করিয়া সুবিধার পথ দিয়া আমাদিগকে স্বার্থপরতার সীমা পর্যন্ত লইয়া যায় ; প্রেমের আকর্ষণ আমাদিগকে সমস্ত গভীর বাহিরে লইয়া, আত্মবিসর্জন করাইয়া, কখনাে ভূতলশায়ী কখনাে অশ্রুসিাগরে নিমগ্ন করে। আবশ্যকের সীমা